প্রতীকী ছবি।
‘‘দাদু খুব অসুস্থ। দূষণের জন্য ডাক্তারবাবুরা তাঁকে মাস্ক পরে থাকতে বলেছেন।’’ বাড়ির কাছে একটি ওষুধের দোকানে গিয়ে এ কথাই বলেছিল নেতাজিনগর শ্রী কলোনির বাসিন্দা নাবালক ছেলেটি। কিন্তু, তার পরে সে আর বাড়ি ফেরেনি। বহু খোঁজাখুঁজির পরেও ওই নাবালককে না পেয়ে তার পরিবার নেতাজিনগর থানার দ্বারস্থ হয়। পুলিশকে পরিজনেরা জানান, তাঁরা শিশুটিকে কোনও মাস্ক কিনতেই পাঠাননি।
অপহরণ, মুক্তিপণ চেয়ে টাকা হাতানোর চেষ্টা-সহ একাধিক সন্দেহ তদন্তকারীদের মনে ঘোরাফেরা করলেও রাতেই পাশের পাড়া থেকে উদ্ধার হয় ওই শিশু। সে জানিয়েছে, বাড়ির লোক তাকে ছাড়ে না। কোথাও বেড়াতেও নিয়ে যায় না। তাই ট্রেনের টিকিট কেটে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’ বাঘা যতীন স্টেশন হয়ে শিয়ালদহ এবং দক্ষিণ শহরতলির বেশ কিছু জায়গায় ঘুরে এসেছে সে। গিয়েছিল বজবজেও।
পুলিশ সূত্রের খবর, শ্রী কলোনির একই বাড়িতে যৌথ পরিবারে থাকে তৃতীয় শ্রেণির ওই ছাত্রটি। তেতলায় বাবা-মায়ের সঙ্গে ঘর তার। নীচে থাকেন শিশুটির দাদু-ঠাকুরমা। বাচ্চাটির বাবা ভ্রমণ ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। বাড়ির একতলায় তাঁর অফিস-ঘর। দুপুরে স্কুল থেকে ফেরা ছেলেকে নিয়ে রোজ ওই অফিস ঘরে পড়তে বসান মা। শনিবারও সেই মতো তিনি ছেলেকে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। তার বাবার কথায়, ‘‘ছেলে অফিস ঘরে আসেনি। কোথায় গেল খোঁজ করতেই জানা যায়, পাড়ার একটি ওষুধের দোকানে গিয়ে দাদুর নাম করে মাস্ক কিনেছে। টাকা কোথায় পেল, তা-ও জানি না। প্রথমে আমাদের মনে হয়, মাস্ক পরিয়ে কেউ হয়তো ওকে তুলে নিয়ে গিয়েছে।’’
দুপুরের মধ্যেই ওই শিশুটির ছবি নিয়ে তদন্ত শুরু করে নেতাজিনগর থানা। এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজে পুলিশ দেখে, সাদা মাস্ক পরে পাড়া দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে সে। দিনভর খোঁজ না মিললেও রাতের দিকে ওই নাবালককে বাঘা যতীন স্যান্ড রোডে দেখা গিয়েছে বলে খবর আসে। নিখোঁজের সন্ধান পাওয়ার খবর যায় পুলিশেও। তদন্তকারীরা গিয়ে বাচ্চাটির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারেন, প্রথমে বাঘা যতীন স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে সে। শিয়ালদহ স্টেশনে ফের ট্রেন বদলে দক্ষিণ শহরতলির নানা স্টেশনে ঘুরে বেড়ায়। বিকেলের দিকে ট্রেনেই সে বজবজে গিয়েছিল বলেও জানায়। এক পুলিশকর্মী বলেন, ‘‘বাচ্চাটা বলেছে, ওকে নাকি বাড়ি থেকে খেলতে দেওয়া হয় না। কোথাও ঘুরতেও নিয়ে যাওয়া হয় না। বাবা-মা সর্বক্ষণ পড়তে বলেন। তাই ঘুরে আসবে বলে বেরিয়ে পড়েছিল। রাস্তায় যাতে কেউ চিনতে না পারে, তাই একটা মাস্কও কিনে নেয়।’’
অত্যাধিক পড়ার চাপ এবং একাকিত্বই শিশুটির এ ভাবে বেরিয়ে পড়ার কারণ বলে মনে করছেন মনোরোগ চিকিৎসকেরাও। তাঁদের প্রশ্ন, ছোটদের উপরে মানসিক চাপ সৃষ্টি না করতে বলে সচেতনতা প্রচার চললেও অভিভাবকদের হুঁশ ফিরবে কবে? কয়েক বছর আগেই এক বন্ধুকে নিয়ে বাড়িছাড়া লিলুয়ার এক নাবালক ফিরে এসে জানিয়েছিল, পরিবার তাকে ছাড়ে না। তাই নিজেই সে ঘুরে এসেছে। দিন কয়েক আগে আবার ইংরেজি বুঝতে না-পারার কথা লিখে রেখে আত্মঘাতী হয়েছেন এক তরুণী। এই ঘটনা-প্রবাহ মনে করিয়ে মনোরোগ চিকিৎসক জয়রঞ্জন রাম বলছেন, ‘‘বড় হওয়ার অর্থ এখন যেন শুধুই পড়াশোনা করা। বাড়ি বা আশপাশের পরিবেশ কতটা অসহনীয় হলে কেউ নিজেকে সরিয়ে নিতে চায়, সেটা বাবা-মায়েদের আগে বোঝা দরকার। এখনই সতর্ক না হলে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে।’’