ট্যাক্সি নেই স্ট্যান্ডে। দুধের শিশুকে কোলে নিয়েই অপেক্ষা। সোমবার শিয়ালদহে। নিজস্ব চিত্র
আগে থেকে না জানা থাকলে যে ভোগান্তি, জানা থাকলেও তা-ই! পাঁচ দিনে দু’বার ট্যাক্সিহীন মহানগরের পথে একই রকম ভুগতে হল মানুষকে।
এমন নয় যে, তিন হাজার টাকা জরিমানা চালুর পরে ট্যাক্সিচালকদের যাত্রী প্রত্যাখ্যানের অভ্যাস কমেছে আদৌ। বরং এ দিকে যাব না, ও দিকে যাব না, পুলিশ ধরে ধরে কেস দিচ্ছে এ সব আরও বেশি করে শুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। যাত্রী ফেরানোর দায়ে সরকারি ঘোষণা মোতাবেক জরিমানা আদায় করা হলেও সেটাকে ‘পুলিশি জুলুম’ আখ্যা দিয়ে গত বৃহস্পতিবার আচমকাই রাস্তা থেকে ট্যাক্সি তুলে নিয়েছিলেন ট্যাক্সিচালকরা। সরকার কার্যত বোকা বনে যাওয়ার কথা স্বীকার করে নিয়ে যুক্তি সাজিয়েছিল, আগে থেকে না জানায় আমজনতাকে ভোগান্তি থেকে রেহাই দেওয়ার কোনও প্রস্তুতি নেওয়া যায়নি। সেই যুক্তি যে কতটা অসার, সোমবার তা প্রমাণ হয়ে গেল।
এ দিন কিন্তু আগে থেকে জানিয়েই ট্যাক্সি বসিয়ে রাখলেন চালকেরা। তাঁরা যাতে এই আন্দোলনে না নামেন, সে জন্য সরকারের পক্ষ থেকে কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল। পাশাপাশি আমজনতার যাতে ভোগান্তি না হয়, তার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে বলে প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিলেন রাজ্যের পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্র। বাস্তবে সেই সরকারি প্রস্তুতির তেমন কোনও নমুনা চোখে পড়ল না সাধারণ মানুষের। হাওড়া ও শিয়ালদহ স্টেশনে দূরপাল্লার ট্রেন থেকে নেমে বিপাকে পড়তে হল বহু মানুষকে। ভিন্ রাজ্যে চিকিৎসা করিয়ে আসা অসুস্থ যাত্রী চোখের জল ফেললেন দমদম বিমানবন্দরে। রাস্তাঘাটে দুর্ভোগে পড়া অসংখ্য মানুষের কথা ছেড়ে দিলেও, এই সব বিপন্ন মানুষকেও উদ্ধার করার কোনও সরকারি প্রয়াস নজরে আসেনি।
বৃহস্পতিবার আচমকা গাড়ি তুলে নেওয়ার পাশাপাশি বেশ কিছু গাড়ি ভাঙচুরও করেন ট্যক্সিচালকেরা। তার জেরে পুলিশ ২১ জন ট্যাক্সিচালককে গ্রেফতার করে। আজ, মঙ্গলবার জেল হেফাজত থেকে নিয়ে গিয়ে তাঁদের আদালতে তোলা হবে। আন্দোলনকারী ট্যাক্সিচালকরা তার আগের দিনই ঘোষণা করে রেখেছেন, ধৃতদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত বিক্ষোভ-আন্দোলন চলবে। এর ফলে আজ, মঙ্গলবার বা তার পরেও শহরের ট্যাক্সি পরিস্থিতি বেহাল হওয়ার আশঙ্কা রয়েই গেল।
ট্যাক্সি নেই। কেঁদেই ফেললেন অসুস্থ রামনারায়ণ মহারাজ। সোমবার কলকাতা বিমানবন্দরে। ছবি: শৌভিক দে
ট্যাক্সিচালকদের আন্দোলন ব্যর্থ করতে শনিবার রাস্তায় নামেন খোদ পরিবহণমন্ত্রী। শিয়ালদহ এবং হাওড়া স্টেশনে ট্যাক্সিচালকদের সঙ্গে কথা বলে মন্ত্রী স্বীকার করে নেন, পুলিশ যে ভাবে যাত্রী প্রত্যাখ্যান করলে তিন হাজার টাকা জরিমানা করছে, তা যথেষ্টই বেশি। যদিও গত মাসে তিনি নিজেই তিন হাজার টাকা জরিমানা করার কথা ঘোষণা করেছিলেন। এমনকী, ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে আগামী ১৩ অগস্ট চালকদের সঙ্গে মুখোমুখি বসার কথাও ঘোষণা করেন মন্ত্রী। তৃণমূলের পক্ষ থেকে পাড়ায়-পাড়ায় মাইক নিয়ে ট্যাক্সিচালকদের আন্দোলন থেকে বিরত থাকার অনুরোধও করা হয়। রবিবারও পরিবহণমন্ত্রীর পক্ষ থেকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ট্যাক্সির আন্দোলন রুখতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়েছে প্রশাসন।
আগাম সতর্কতা সত্ত্বেও কেন চালকদের আন্দোলনের মোকাবিলা করা গেল না? এর কোনও জুতসই ব্যাখ্যা দিতে পারেননি মন্ত্রী-সহ পরিবহণ দফতরের তাবড় কর্তারা। তবে পরিবহণ-কর্তাদের অনেকেই এর পিছনে পুলিশের উপরে ট্যাক্সিচালকদের ক্ষোভকেই দায়ী করেছেন। পরিবহণমন্ত্রী অবশ্য এ দিনের আন্দোলনকে সিপিএমের পরিকল্পিত চক্রান্ত বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “সিপিএম রাজ্যে বিশৃঙ্খলার রাজনীতি ফেরাতে চাইছে। ট্যাক্সিচালকদের আমরা এই চেষ্টা থেকে সাবধান থাকতে বলছি। সরকার ট্যাক্সিচালকদের সমস্যা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। ১৩ তারিখ আমরা তাঁদের সঙ্গে বসে, আলোচনা করে সমস্যার সমাধান করব।”
মন্ত্রীর আলোচনার আশ্বাস উপেক্ষা করেই আন্দোলনকারীরা এ দিন বন্ধ রেখেছিলেন ট্যাক্সির চাকা। ১৩ তারিখের ওই আলোচনা বয়কটের কথাও ঘোষণা করেছেন তাঁরা। আন্দোলনকারীদের সাফ বক্তব্য, “পুলিশি জুলুম বন্ধ না-হলে, চালকদের উপর থেকে মামলা না-তুললে, সরকারের সঙ্গে কোনও আলোচনায় বসার প্রশ্নই নেই।” বৃহস্পতিবার ট্যাক্সিচালকদের আন্দোলনে সিটু-এআইটিইউসি-র সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন বিজেপির শ্রমিক নেতারা। এ দিন আবার আইন অমান্যে যোগ দেয় কংগ্রেসের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিইউসি-ও। তাতে ট্যাক্সিচালকদের আন্দোলন আরও শক্তিশালী হয়েছে বলেই মনে করছেন পরিবহণ-কর্তারা।
গত বৃহস্পতিবারের মতো এ দিনও হাওড়া-শিয়ালদহ স্টেশন ও বিমানবন্দর শুধু নয়, সারা শহর জুড়েই ট্যাক্সির অভাবে যাত্রীদের ভুগতে হয়েছে। সকালে হাতেগোনা ট্যাক্সি রাস্তায় থাকলেও বেলা যত বেড়েছে, ততই রাস্তা ট্যাক্সিহীন হয়ে গিয়েছে। মওকা বুঝে প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া চেয়েছে চার-পাঁচ গুণ। ট্যাক্সি খুঁজতে গিয়ে অনেক যাত্রীই হয়রান হয়ে গিয়ে শেষমেশ ভিড়ে ঠাসা বাসে চড়ে কোনও রকমে গন্তব্যে পৌঁছেছেন। কিন্তু এ দিন দুপুর থেকে হাওড়া স্টেশন চত্বরে বাসও নজরে এসেছে হাতে গোনা। তাতে আরও হয়রানির মুখে পড়েন যাত্রীরা।
এ দিন বিমানবন্দরের ভিতরে হলুদ ট্যাক্সির প্রি-পেড বুথও ছিল সুনসান। নীল-সাদা ট্যাক্সির বুথে গাড়ি থাকলেও অন্য দিনের তুলনায় সার্বিক ভাবে বিমানবন্দরে ট্যাক্সির সংখ্যা ছিল নগণ্য। পরিস্থিতি সামাল দিতে হিমসিম খেতে হয়েছে কর্তব্যরত নিরাপত্তাকর্মী ও পুলিশকর্মীদের। সাড়ে বারোটা নাগাদ হায়দরাবাদ থেকে বিমানবন্দরে নামেন ইছাপুরের বাসিন্দা অসুস্থ রামনারায়ণ মহারাজ এবং তাঁর স্ত্রী। ট্যাক্সি না পেয়ে দিশেহারা ও অসুস্থ রামনারায়ণ বিমানবন্দরে বসেই কাঁদতে থাকেন। পরে চড়া দামে গাড়ি ভাড়া করে বাড়ি ফেরেন তাঁরা।
শুধু যাত্রী-ভোগান্তিই নয়, এ দিন ট্যাক্সিচালকদের আন্দোলনকে ঘিরে ছোটখাটো হিংসাও ছড়িয়েছে। চিত্তরঞ্জন অ্যাভিনিউয়ে ‘রোগী’ লেখা একটি ট্যাক্সির উপরে চড়াও হন আন্দোলনকারীরা। গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। ধর্মতলায় বেশ কয়েকটি ট্যাক্সি থেকে যাত্রীদের জোর করে নামিয়েও দেওয়া হয়।
যাত্রীদের ভোগান্তি উপেক্ষা করেই অবশ্য এ দিন ফের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা ঘোষণা করেছেন সিটু-এআইটিইউসি এবং আইএনটিইউসি-র নেতারা। এ দিন আইন অমান্যের মঞ্চ থেকেই ঘোষণা করে দেওয়া হয়, ধৃত ট্যাক্সিচালকদের মুক্তি না দেওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। সিটু নেতা শ্যামল চক্রবর্তী বলেন, “২১ জন ধৃত ট্যাক্সিচালককে বিনা শর্তে মুক্তি দিতে হবে। না-হলে চালকেরা স্টিয়ারিং ধরবেন না। তিন হাজার টাকা জরিমানাও নেওয়া যাবে না। উৎসবের জন্য তহবিলে টান পড়লে সরকার ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে দাঁড়াক, সাধারণ মানুষ অর্থ দেবেন।”