তিন দিনে তিন ঘটনা! মহানগরীতে ক্রমশই বাড়ছে ট্যাক্সির দৌরাত্ম্য।
শনিবার রাতে বানতলায় চলন্ত ট্যাক্সিতে মহিলার শ্লীলতাহানি করেন এক চালক। নিগ্রহ থেকে বাঁচতে চলন্ত ট্যাক্সি থেকেই নেমে পড়েন মহিলা। রবিবার রাতে যাত্রী প্রত্যাখানের প্রতিবাদ করায় চালক ও তার সঙ্গীদের হাতে মার খান এক প্রবাসী ব্যবসায়ী ও তাঁর বন্ধু। এই ধারাবাহিক ঘটনার সর্বশেষ উদাহরণ সোমবার বিকেলে বালি এলাকায় ২ নম্বর জাতীয় সড়ক। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা এক মহিলার হাত ধরে টানেন এক ট্যাক্সিচালক।
ট্যাক্সিচালকদের বিরুদ্ধে যাত্রী প্রত্যাখানের অভিযোগ আগেই ছিল। এ বার তার সঙ্গে জুড়ে গিয়েছে গুন্ডামি-শ্লীলতাহানির মতো অপরাধের অভিযোগও! এবং এক এক বার অভিযোগের সঙ্গেই মন্ত্রী-নেতা-পুলিশ সকলেই নানা হুমকি-হুঁশিয়ারি দিয়ে দৌরাত্ম্য বন্ধের কথা বলেন। কিন্তু ট্যাক্সিচালকেরা যে সে সব থোড়াই কেয়ার করেন, শনি-রবি-সোমবারের তিন ঘটনাই ফের তা স্পষ্ট করে দিল।
কলকাতা পুলিশ বলছে, ট্যাক্সি চালকদের দৌরাত্ম্য যে বাড়ছে, গত দু’মাসে প্রত্যাখানের অভিযোগ থেকেই তা পরিষ্কার। মে ও জুন মাসে লালবাজারের কাছে চার হাজারেরও বেশি অভিযোগ জমা পড়েছে। ট্রাফিক পুলিশের একাংশ বলছেন, প্রত্যাখানের যত ঘটনা ঘটে, তার সিকিভাগও অভিযোগ দায়ের হয় না। তাই সঠিক হিসেব ধরলে শহরে প্রতি মাসে অভিযোগের সংখ্যা পাঁচ হাজার পেরিয়ে যাবে বলে পুলিশের অনুমান। এ সব দেখেই এক পুলিশকর্তার মন্তব্য, “বেপরোয়া না হলে এত প্রত্যাখান করতে পারেন না ট্যাক্সিচালকেরা।”
ট্যাক্সিচালকদের এমন দৌরাত্ম্যে রীতিমতো আতঙ্কে মহিলা যাত্রীরা। অনেকেই বলছেন, আগে শুধু প্রত্যাখানেই হেনস্থা শেষ হত। আর এখন গাড়িতে উঠে নিগ্রহের শিকার হতে হচ্ছে! মাস খানেক আগেই এমন পরিস্থিতির মুখে পড়েছিলেন শম্ভুনাথ পণ্ডিতের বংশধর মমতা পণ্ডিত। খাস পার্ক স্ট্রিটে ওই মহিলা ও তাঁর সঙ্গীদের চলন্ত গাড়ি থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন এক ট্যাক্সিচালক। সেই ঘটনা যে কোনও বিচ্ছিন্ন উদাহরণ ছিল না, গত তিন দিনে মহানগরের তিনটি ঘটনা, সেটাই কার্যত প্রমাণ করেছে।
শহরতলির বাসিন্দাদের অভিজ্ঞতা বলছে, কলকাতার পুলিশের আওতাধীন এলাকা পেরোলে এই ছবিটা আরও প্রকট। মধ্যমগ্রাম-নিউ ব্যারাকপুর এলাকার ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে কোনও চালকই মিটারে ভাড়া যান না। এয়ারপোর্ট হোক বা নিউ টাউন, তিনশো টাকার নীচে ভাড়া নিতে রাজি নন তাঁরা। কোনও যাত্রী আপত্তি উত্তর মেলে, “ভাড়া দিতে না পারলে বাসে চলে যান।” তর্ক জুড়লে দল বেঁধে যাত্রীর উপরে চড়াও হওয়াটাও নজিরবিহীন নয়।
ট্যাক্সিচালকদের এমন দৌরাত্ম্যে বিরক্ত ট্যাক্সিমালিকদের সংগঠনও। সংগঠনের নেতারা বলছেন, জরিমানা হলে তা মালিকদের ঘাড়ে চাপে। ফলে চালকদের উপরে কোনও প্রভাব পড়ে না। অবাধ্য চালকদের বিরুদ্ধে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে পুলিশকে। কিন্তু ট্যাক্সি সংগঠন ব্যবস্থা নেয় কি?
বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক বিমল গুহ বলছেন, “পুলিশ-পরিবহণ দফতরের পাশাপাশি আমাদের কাছেও অভিযোগ এলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।” তাঁর দাবি, গত দু’মাসে চারটি ট্যাক্সিচালককে কাজ থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। তোপ দেগেছেন পরিবহণমন্ত্রী মদন মিত্রও। তিনি বলেছেন, পুলিশকে কড়া ব্যবস্থা নিতে হবে। ৩০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানা করা হবে। “কার পিছনে কত বড় নেতা আছে, তা দেখে নেব।”ট্যাক্সিচালকদের উদ্দেশে বলছেন মদনবাবু। পুলিশ সূত্রের খবর, চালকদের দৌরাত্ম্য ঠেকাতে আজ, মঙ্গলবার পরিবহণ ভবনে মন্ত্রীর সঙ্গে ট্যাক্সি সংগঠন ও পুলিশের বৈঠক হওয়ার কথা। কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানিয়েছে পুলিশও।
অনেকে অবশ্য বলছেন, যে ভাবে যাত্রীদের প্রত্যাখান করা হয়, তাতেও হেনস্থা কিছু কম হয় না। নিত্য এমন প্রত্যাখান সওয়া এই শহরের বাসিন্দা শৈবাল দে-র কথায়, “ট্যাক্সিচালকদের ইচ্ছো মতো যাত্রীদের চলতে হবে, এটা কেমন নিয়ম!”
লালবাজারের দাবি, ট্যাক্সি দৌরাত্ম্য ও যাত্রী প্রত্যাখান রুখতে ইতিমধ্যেই ৩০০০ হাজার টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রয়োজনে লাইসেন্স ‘পাঞ্চ’ করে দেওয়া হচ্ছে। তিন বার ‘পাঞ্চ’ হলে লাইসেন্স বাতিল হয়ে যাবে। পুলিশের এক কর্তার বক্তব্য, “লাইসেন্স পাঞ্চ হলে চালকেরই ক্ষতি। আশা করি, এই দাওয়াইয়ে কাজ হবে।”
এর পাশাপাশি শহরে যাত্রী প্রত্যাখান রুখতে আজ, মঙ্গলবার থেকে শহরের দশটি এগারোটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গার ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে পুলিশ মোতায়েন করা হবে। কলকাতা পুলিশের এক ট্রাফিক কর্তার বক্তব্য, “আপাতত এটি পরীক্ষামূলক ভাবে করা হচ্ছে। এটি সফল হলে গোটা শহরেই এমন ব্যবস্থা করা হবে।”
রবিবার রাতে ভবানীপুরে যাত্রী নিগ্রহের ঘটনাতে অভিযুক্ত ট্যাক্সিচালক রোহিত সিংহকে গ্রেফতার করা হয়। সোমবার বিকেলে আলিপুর আদালত থেকে জামিনে ছাড়া পেয়েছেন।