স্কুলের ছাদ থেকে কিশোরের মরণঝাঁপ

দুপুরের দিকে হাত থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল তার। সহপাঠীরা জানিয়েছিল, ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা চিরে ফেলেছে সে। স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক চিকিৎসা করে তাকে ক্লাসে পাঠান। কিছুক্ষণ পরে সেই ছেলেকেই দেখা গেল একতলায় ফাইবারের শেডের উপরে পড়ে থাকতে। জানা গেল, সকলের নজর এড়িয়ে স্কুলের ছ’তলার ছাদে উঠে গিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্র।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৫ ০০:৫১
Share:

ঝাঁপ দিয়ে এখানেই পড়েছিল অনুরাগ। শুক্রবার। —নিজস্ব চিত্র।

দুপুরের দিকে হাত থেকে ঝরঝর করে রক্ত পড়ছিল তার। সহপাঠীরা জানিয়েছিল, ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা চিরে ফেলেছে সে। স্কুল কর্তৃপক্ষ প্রাথমিক চিকিৎসা করে তাকে ক্লাসে পাঠান। কিছুক্ষণ পরে সেই ছেলেকেই দেখা গেল একতলায় ফাইবারের শেডের উপরে পড়ে থাকতে। জানা গেল, সকলের নজর এড়িয়ে স্কুলের ছ’তলার ছাদে উঠে গিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিল অষ্টম শ্রেণির ওই ছাত্র। বাইপাসের এক বেসরকারি হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানেই মৃত্যু হল তার। তেরো বছরের ওই কিশোরের নাম অনুরাগ বসাক।

Advertisement

শুক্রবার দুপুর আড়াইটে নাগাদ ভিআইপি রোডের ধারে একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে এই ঘটনায় চাঞ্চল্য ছড়ায়। স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল শর্মিষ্ঠা ঘটক জানান, অনুরাগের ক্লাসরুম ছিল পাঁচতলায়। ওই ছাত্রের ক্লাসরুমের পিছনে একতলা থেকে ছাদ পর্যন্ত একটি লোহার সিঁড়ি রয়েছে। কিন্তু সেই সিঁড়ির গেটে তালা বন্ধ থাকে। ছাদে ওঠার সিঁড়ি আর ছ’তলা ও পাঁচ তলায় নামার সিঁড়ির সংযোগস্থলে একটি এক ফালি জায়গা রয়েছে। সেখান দিয়েই অনুরাগ ছাদে পৌঁছে গিয়েছিল বলে তাঁদের ধারণা। শর্মিষ্ঠাদেবী বলেন, ‘‘আমরা ছাত্রছাত্রীদের থেকে জেনেছি ছেলেটি স্কুলেরই এক ছাত্রীকে চিঠি লিখেছিল। কিন্তু ওই ছাত্রী তাতে আপত্তি জানায়।’’

বাগুইআটি থানার পুলিশেরও দাবি, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে এই ঘটনার পিছনে প্রেমঘটিত কারণের ইঙ্গিত মিলেছে। পুলিশের অনুমান, তার জেরেই প্রথমে সে ব্লেড দিয়ে হাতের শিরা কাটার চেষ্টা করে এবং পরে ছাদ থেকে ঝাঁপ দেয়। মনোবিদেরা বলছেন, এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের সর্বদাই জিততে শেখান বড়রা। হার মেনে নেওয়াটা শিখতে না পেরেই যে কোনও রকমের ধাক্কা, প্রত্যাখ্যান বা হার এলেই এই ধরনের ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা দেয় তাদের মধ্যে।

Advertisement

এ দিনের ঘটনার আকস্মিকতায় ভয় পেয়ে যায় অন্য ক্লাসের ছাত্রছাত্রীরা। সহপাঠীরা জানায়, দুপুরের দিকে এক বার অনুরাগ ব্লেড দিয়ে হাত কাটে। হাত থেকে রক্ত বেরোতে দেখে তারা বিষয়টি এক শিক্ষিকাকে জানায়। স্কুল কর্তৃপক্ষের দাবি, ওই শিক্ষিকা স্কুলের ভিতরেই অনুরাগের প্রাথমিক চিকিৎসা করিয়ে ক্লাসে পাঠান। এর পরেই সকলের নজর এড়িয়ে ছাদে উঠে গিয়ে রেলিং টপকে ঝাঁপ দেয় সে। এক সহপাঠীও জানায়, স্কুলের ছ’তলার হলঘরে এ দিন ক্যুইজ প্রতিযোগিতা ছিল। অনুরাগ তাতে যোগ দিয়েছিল। তার পরেই সকলের চোখ এড়িয়ে হলঘরের লাগোয়া ছাদ থেকে সে ঝাঁপ দেয়।

এ দিন ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, থমথম করছে গোটা স্কুল। স্কুল একতলার ওই ফাইবারের শেডটি দুমড়ে গিয়েছে। স্কুলের চত্বরে বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে রক্তের দাগ। মাটিতে পড়ে রয়েছে অনুরাগের দু’পাটি জুতো। স্কুলের বহু ছাত্রছাত্রীই জানিয়েছে, কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ পেয়েছিল তারা। তার পরেই দেখা যায় এই কাণ্ড। ঘটনায় শোকাহত হয়ে পড়ে সহাপাঠীরা। ছুটির পরে বেরোনোর সময়ে অনেককেই কান্নাকাটি করতে দেখা যায়। কাঁদছিলেন কয়েক জন অভিভাবকও। সোমা চক্রবর্তী নামে এক অভিভাবিকা বলেন,‘‘সকালেই স্কুলে অনুরাগের মায়ের সঙ্গে কথা বললাম। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটে গেল!’’

যেখান থেকে ঝাঁপ দেয় অনুরাগ। সবিস্তার দেখতে ক্লিক করুন।

স্কুল কর্তৃপক্ষের বক্তব্যের সঙ্গে অবশ্য সহমত নয় অনুরাগের পরিবার। প্রেমে ব্যর্থ হয়ে অনুরাগ ঝাঁপ দিয়েছে বলে তাঁরা বিশ্বাস করছেন না বলেই দাবি বসাক পরিবারের। বরং ঘটনার পিছনে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের প্রতি নজরদারিতে স্কুলের ত্রুটি রয়েছে বলেই দাবি অনুরাগের আত্মীয়দের। শুক্রবার রাতে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বাগুইআটি থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছে বসাক পরিবার। এ দিন অনুরাগের বাবা সঞ্জয় বসাকের বন্ধু স্বপন দে বলেন, ‘‘নার্সারি থেকে অনুরাগ ওই স্কুলে পড়ছে। অথচ আজ দুপুরে যখন ওর হাত কাটল, তখনই কেন স্কুল থেকে অভিভাবককে বিষয়টি জানানো হল না? নিজেদের দোষ ঢাকতে স্কুল গল্প সাজাচ্ছে।’’ তাঁদের আরও অভিযোগ, স্কুলের যে জায়গা থেকে অনুরাগ ঝাঁপ মেরেছে বলে দাবি করা হচ্ছে, সেখানে তো উঁচু পাঁচিল রয়েছে বলে স্কুলের তরফেই জানানো হয়েছে। তা হলে অনুরাগ ঝাঁপাল কী করে, প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। তাঁদের আরও অভিযোগ, অত উঁচু থেকে পড়েও অনুরাগের হাত-পা বা শরীরের অন্য কোথাও চোট লাগল না, শুধু মাথার পিছনে আঘাতের চিহ্ন। মৃত্যুর পিছনে অন্য কারণ থাকতে পারে বলে মনে করছেন তাঁরা। তাই স্কুলের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ দায়ের করছেন বলে জানিয়েছেন পরিজনেরা।

দুর্ঘটনার পরে অনুরাগকে ই এম বাইপাসের ধারে একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করে হাসপাতাল। একমাত্র ছেলের দুর্ঘটনার ধাক্কা সামলাতে না পেরে অসুস্থ হয়ে পড়েন অনুরাগের মা চামেলীদেবী। ওই হাসপাতালেরই জরুরি বিভাগে তাঁকেও ভর্তি করতে হয়। সন্ধ্যা পর্যন্ত ছেলের মৃত্যুসংবাদ তাঁকে দেওয়া হয়নি বলেই জানায় অনুরাগের পরিবার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement