আইএনএস দুনাগিরি। ছবি: টুইটার থেকে নেওয়া।
ভারতীয় নৌসেনাকে ‘মেঘনাদ’ বানিয়ে দিল কলকাতা। বানিয়ে দিল মধুকবির শহরের ‘গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্স’।
‘মেঘনাদবধ’ কাব্যে রাবণের সেনাপতি ইন্দ্রজিতের কথা লিখেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। যিনি ছিলেন ‘মেঘনাদ’। মেঘের আড়াল থেকে যুদ্ধ করতেন। তিনি কোথায় আছেন, ঠাহর পেত না বিপক্ষ সেনাবাহিনী। মেঘের অন্তরাল থেকে তিনি শক্তিশেল হেনেছিলেন লক্ষ্মণের বুকে। ভারতীয় নৌবাহিনীকে যে ‘মেঘনাদ’ বানিয়ে দিল মধুসূদনের শহর, তারও হদিস পাওয়া যায় না। তারও গতিবিধি ধরা পড়ে না অত্যাধুনিক রাডারে। আড়ালে থেকেই সে শত্রুপক্ষের উপর আঘাত হানতে পারে।
পোশাকি নাম ‘আইএনএস দুনাগিরি’। ওজন ৬,৬০০ টন। গোত্রে ‘ফ্রিগেট’ (ছোট রণতরী)। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একটি সূত্রের দাবি, আইএনএস দুনাগিরি ভারতীয় নৌবাহিনীর আধুনিকতম ‘স্টেল্থ’ রণতরী। শুক্রবারেই কলকাতায় হুগলি নদীর জলে ভাসানো হল তাকে। তার সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক সমরাস্ত্রে আরও একটি ধাপ এগিয়ে গেল ভারত।
‘আইএনএস দুনাগিরি’ নামে একটি যুদ্ধজাহাজ ১৯৭৭ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ভারতীয় নৌসেনায় ছিল। ‘ল্যান্ডি ফ্রিগেট’ গোত্রের ওই রণতরীটি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উপকূল অঞ্চলে সেনা ও সামরিক উপকরণ অবতরণে সক্ষম ছিল। ৩৩ বছরের কর্মজীবন শেষে অবসর নেয় সেই ফ্রিগেটটি। এ বার তারই নামে নামকরণ হল গার্ডেনরিচে তৈরি ‘স্টেলথ ফ্রিগেটের’।
আইএনএস দুনাগিরি।
এই রণতরী সমুদ্রের অন্দরে গিয়ে ‘আড়াল’ খুঁজে নিতে পারে। পাশাপাশিই শত্রুপক্ষের রাডারের নজরদারিকে ফাঁকি দিয়ে হামলা চালাতে পারে দ্রুত। শক্তিশালী ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাত হেনে ধ্বংস করতে পারে শত্রুর জলযান বা আস্ত বন্দর। যেমন ‘রামায়ণ’-এ করতেন ‘মেঘনাদ’।
ভারতীয় নৌবাহিনীর ‘আঁতুড়ঘর’ হিসেবে পরিচিত কলকাতার ‘গার্ডেনরিচ শিপ বিল্ডার্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়র্স লিমিটেড’। এই জাহাজ কারখানায় বহু বছর ধরে তৈরি হয়েছে বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধজাহাজ। সেই তালিকায় নবতম সংযোজন ‘স্টেলথ’ (রাডার নজরদারি ফাঁকি দিতে সক্ষম) আইএনএস দুনাগিরি।
ঘটনাচক্রে, শুক্রবারই গার্ডেনরিচে নৌবাহিনীর কর্মসূচিতে আনুষ্ঠানিক ভাবে দুনাগিরিকে জলে ভাসিয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। পি-১৭এ (শিবালিক) শ্রেণির ‘স্টেলথ ফ্রিগেট’ আইএনএস উদয়গিরিকে চলতি বছরের মে মাসে ভারতীয় নৌবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। ভারতীয় নৌবাহিনীর ‘ডিরেক্টরেট অফ ন্যাভাল ডিজাইন’ (ডিএনডি)-এর নকশায় তৈরি ওই যুদ্ধজাহাজটি তৈরি করেছিল মুম্বইয়ের ‘মাঝগাঁও ডক ইয়ার্ড’।
ভারতীয় নৌবাহিনীকে আধুনিক যুদ্ধের উপযোগী করে তোলার উদ্যোগ শুরু হয়েছিল ইউপিএ সরকারের আমলেই। সেই পরিকল্পনারই অঙ্গ হিসেবে পি-১৭এ প্রকল্পে মোট সাতটি শিবালিক গোত্রের ‘স্টেলথ ফ্রিগেট’ নির্মাণ শুরু হয় প্রায় দেড় দশক আগে। ২০১০ সালে জলে ভাসে ওই গোত্রের প্রথম ফ্রিগেট ‘আইএনএস শিবালিক’। এর পর ২০১১ সালে ‘আইএনএস সতপুরা’ এবং ২০১২ সালে ‘আইএনএস সহ্যাদ্রি’।
২০১৯ এবং ২০২০ সালে মুম্বইয়ের মাঝগাঁও জাহাজ নির্মাণ কারখানায় তৈরি দু’টি ‘স্টেলথ ফ্রিগেট’ রণতরী ‘আইএনএস নীলগিরি’ এবং ‘আইএনএস হিমগিরি’কে আনুষ্ঠানিক ভাবে জলে ভাসানো হয়েছিল। এ বার এ বার সেই গোত্রের আধুনিকতম সংস্করণটি বানাল গার্ডেনরিচ। বেজিংয়ের প্রভাবাধীন দক্ষিণ চিন সাগরে ইতিমধ্যেই সাফল্যের সঙ্গে ‘কোয়াড’ (ভারত, আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে গঠিত জোট) জোটের দেশগুলির সঙ্গে যৌথ নৌ-মহড়ায় অংশ নিয়েছে শিবালিক।
শুধু ‘স্টেলথ ফ্রিগেট’ নয়, নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে ‘আত্মনির্ভর ভারত’ স্লোগান সামনে রেখে সামগ্রিক ভাবে প্রতিরক্ষায় দেশীয় উৎপাদনক্ষেত্রকে শক্তিশালী করার চেষ্টা শুরু। নৌবাহিনীও রয়েছে সেই তালিকায়। ২০২৭ সালের মধ্যে ভারতীয় নৌবাহিনীর ভান্ডারে অন্তত ২০০টি বিভিন্ন শ্রেণির যুদ্ধজাহাজ মজুত করার লক্ষ্য নিয়েছে কেন্দ্র। নতুন যুদ্ধজাহাজগুলির বড় অংশই কলকাতা, কোচি, মুম্বই-সহ দেশের বিভিন্ন ডক ইয়ার্ডে তৈরি হবে।
২০২০ সালে দেশীয় সামরিক উৎপাদন ক্ষেত্রগুলিকে চাঙ্গা করার লক্ষ্যে ১০১ রকমের প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম আমদানির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। তার মধ্যে ছিল নৌসেনার ব্যবহৃত রাডার, ‘সোনার’ (ডুবোজাহাজ সন্ধানী যন্ত্র), ভূমিতে আঘাত হানতে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র, হাল্কা পরিবহণ বিমান ও হাল্কা হেলিকপ্টার। প্রশিক্ষণ বিমান ও চালকহীন বিমানও ছিল সেই তালিকায়।
এর পাশাপাশি শুরু হয়েছে, দেশীয় প্রযুক্তিতে ভারী যুদ্ধজাহাজ এবং ডুবোজাহাজ তৈরির উদ্যোগও। গত বছরের অগস্টে ভারতে তৈরি প্রথম বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজ ‘আইএনএস বিক্রান্ত’ জলে ভেসেছিল। গত মে মাসে ভারতীয় নৌসেনার অস্ত্রাগারে এসেছে চতুর্থ পি-১৫বি শ্রেণির ‘গাইডেড মিসাইল ডেস্ট্রয়ার’ আইএনএস সুরত।
ফ্রিগেটের পাশাপাশি শত্রুপক্ষের সোনার-নজরদারি ফাঁকি দিতে সক্ষম ছ’টি স্টেলথ ডুবোজাহাজ তৈরির কাজও চলছে পুরোদমে। ফরাসি সংস্থা ‘ডিসিএনএস’-এর সঙ্গে নকশা ও প্রযুক্তিগত সহায়তা চুক্তির ভিত্তিতে মোট ৬টি ‘কলভরী’ গোত্রের ‘স্করপেন’ ডুবোজাহাজ বানানো হচ্ছে ভারতে। এই প্রকল্পের আনুষ্ঠানিক নাম ‘প্রজেক্ট ৭৫’।
প্রথম ভারতীয় স্করপেন ‘আইএনএস কলভরী’কে ২০১৫ সালের অক্টোবরে নৌবাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল। কলভরীর পর স্করপেন শ্রেণির ডুবোজাহাজ ‘আইএনএস খাণ্ডেরী’, ‘আইএনএস করঞ্জ’ এবং ‘আইএনএস ভেলা’ ভারতীয় নৌবাহিনীর কাজে যোগ দেয়। ওই গোত্রের পঞ্চম এবং ষষ্ঠ তথা শেষ স্করপেন ‘আইএনএস বাহীর’ এবং ‘আইএনএস বাগশির’-এর নির্মাণের কাজ শেষ। গভীর সমুদ্রে তাদের কর্মক্ষমতা পরীক্ষার কাজ চলছে বলে নির্মাণকারী সংস্থার তরফে জানানো হয়েছে।