সরকারি হাসপাতালের আয় বাড়াতে বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে হয়েছিল চুক্তি। কিন্তু কয়েক বছর পর দেখা গেল, চুক্তি রয়ে গিয়েছে খাতার পাতায়। বেসরকারি সংস্থা ঠিক নিজের কার্যসিদ্ধি করে নিচ্ছে, কিন্তু তাদের কাছ থেকে সরকারি হাসপাতালের যে প্রাপ্য টাকা আর পরিষেবা পাওয়ার কথা, তাতে বিস্তর ফাঁক থেকে যাচ্ছে। পাওয়া যাচ্ছে আর্থিক দুর্নীতির গন্ধ। সেই গন্ধের উৎস খুঁজতেই চলতি মাসে তদন্ত শুরু করেছেন এসএসকেএম হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
সরকারি হাসপাতালের ভাঁড়ারে অর্থ বাড়াতে হাসপাতাল চত্বরে হোর্ডিং লাগাতে দেওয়া, স্টল বসানো, ব্যাঙ্কের এটিএম বসানো, হাসপাতালের প্রেক্ষাগৃহ ভাড়া দেওয়ার চল রয়েছে অনেক দিন ধরেই। এর বিনিময়ে যে টাকা রোজগার হয়, তা হাসপাতালের তহবিলে যায় এবং প্রধানত রোগী কল্যাণে খরচ হয়। রোগী কল্যাণের মধ্যে হাসপাতালের স্টোরে অমিল কোনও জরুরি ওষুধ বা চিকিৎসা-সামগ্রী কেনা থেকে শুরু করে যন্ত্রপাতি সারানো— সবই পড়ে।
গত কয়েক বছরে রাজ্যের প্রধান সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতাল এসএসকেএম-ও একাধিক সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছিল। তাতে হাসপাতাল চত্বরে হোর্ডিং, এটিএম বা খাবারের স্টল বসানোর বিনিময়ে হাসপাতালের মাসিক বা বার্ষিক মোটা টাকা পাওয়ার কথা ছিল। সেই সঙ্গে ওই সংস্থাগুলি নিখরচায় হাসপাতাল পরিচ্ছন্ন রাখা, বিভিন্ন বিষয়ে জনসচেতনতা বাড়াতে ফ্লেক্সি বোর্ড লাগানো, পার্ক-বাগান-ফোয়ারা তৈরি করা বা ওয়ার্ডে নতুন শয্যা, বালিশ, আলো, পাখা কিনে দেওয়ার মতো পরিষেবা দিতে সম্মত হয়েছিল।
কিন্তু ঠিক পুজোর আগে কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে বর্তমান কর্তৃপক্ষের নজরে আসে, বহু সংস্থার কয়েক লক্ষ টাকা করে বকেয়া রয়েছে। যে হারে তাদের টাকা বাড়ানোর কথা ছিল, তার সিকিভাগও কোনও সংস্থা বাড়ায়নি। এমনকী হাসপাতালে নিখরচায় তাদের যে পরিষেবাগুলি দেওয়ার কথা, সেটাও বিন্দুমাত্র দেয়নি। অথচ হাসপাতাল চত্বরে তারা দিব্যি নিজেদের হোর্ডিং লাগিয়ে রেখেছে, স্টল চালাচ্ছে।
সংস্থাগুলি থেকে যে টাকা এসএসকেএমের প্রাপ্য কিন্তু পাওয়া যায়নি, সেই অঙ্কটা প্রায় ২৫ লক্ষের কাছাকাছি। এসএসকেএমের সুপার করবী বড়ালের কথায়, ‘‘পুরনো ফাইল খুঁজে কোন সংস্থার কত বছরের কত টাকা বাকি, সব বার করে প্রত্যেককে চিঠি পাঠানো হয়েছে। স্বাস্থ্য ভবনকেও জানিয়েছি। ইতিমধ্যে বেশ কিছু সংস্থার প্রতিনিধিরা এসে ক্ষমা চেয়ে গিয়েছেন। বলে গিয়েছেন, কিছু দিনের মধ্যেই সব টাকা মিটিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু প্রাথমিক তদন্তে আরও গভীর দুর্নীতির আঁচ পাওয়া যাচ্ছে বলে আমরা উদ্বিগ্ন।’’
সেটা কী রকম? হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ব্যাখ্যা দেন, প্রাথমিক তদন্তে জানা যাচ্ছে, হাসপাতালের কর্মী-অফিসারদের একাংশ এর সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এঁদের টাকা ও অন্য সুবিধা দিয়ে কিছু সংস্থা হাসপাতালের পাওনা মাসের পর মাস বাকি রেখেও দিব্যি পার পেয়ে গিয়েছে। পূর্বতন কর্তৃপক্ষেরা এত বছর বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া না করে কেন চুপ করে ছিলেন, উঠেছে সে প্রশ্নও। অধ্যক্ষ মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে মুখে কুলুপ এঁটেছেন।
প্রাথমিক তদন্তে আরও দেখা গিয়েছে, এই সব হোর্ডিং, স্টলগুলির অধিকাংশতে আলাদা ইলেকট্রিক মিটার খুঁজে পাওয়া যায়নি। বেআইনি ভাবে হাসপাতাল থেকে বিদ্যুৎ নিয়েই এগুলি চালানো হচ্ছিল। এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত তথ্য পেতে পুর্ত দফতর ও সিইএসসি-কেও চিঠি লিখেছেন হাসপাতালের বর্তমান কর্তৃপক্ষ।
অনিয়মের কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। যেমন, ক্যালকাটা অ্যাড এজেন্সি নামে একটি সংস্থার সঙ্গে ২০১১ সালে চুক্তি হয় এসএসকেএমের। কথা ছিল, হাসপাতালে হোর্ডিং লাগানোর বিনিময়ে তারা প্রতি বছর ১ লক্ষ টাকা করে দেবে। ৩ বছর অন্তর এই টাকার অঙ্ক ১৫ শতাংশ বাড়বে। পাশাপাশি, তাঁরা এসএসকেএমের এজেসি বসু রোড সংলগ্ন চত্বর পরিচ্ছন্ন রাখবে, বাচ্চাদের খেলার পার্ক তৈরি করবে হাসপাতাল চত্বরে এবং এড্স-সচেতনতা সংক্রান্ত ইলেকট্রনিক ডিসপ্লে বোর্ড লাগাবে। কিন্তু এখন নথি ঘেঁটে দেখা যাচ্ছে, ২০১৩ ও ২০১৫ সালে তারা কোনও টাকা হাসপাতালকে দেয়নি। টাকা বাড়ায়ওনি। চুক্তিমতো হাসপাতাল চত্বর পরিষ্কার রাখা, পার্ক তৈরি বা ডিসপ্লে বোর্ড বসানোর কাজও করেনি। হাওড়ার ওই সংস্থার তরফে সুশান্ত মণ্ডলের যুক্তি, ‘‘একটু অসুবিধা ছিল তাই টাকাটা দেওয়া হয়নি। তবে এখন সব দিয়ে দেব।’’
হাওড়ার আর একটি সংস্থা মুনশাইন অ্যাড এজেন্সি-ও চুক্তি অমান্য করে ২০১১ ও ২০১৩ সালে কোনও টাকা এসএসকেএমকে দেয়নি। তাদের বছরে ৬০ হাজার টাকা দেওয়ার কথা। চুক্তির তিন বছর পরে তারা ১৫ শতাংশ টাকা বাড়ায়নি। ওই সংস্থার তরফে প্রজাপতি মণ্ডলের বক্তব্য, ‘‘কিছু ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ঠিক করে নেওয়া হচ্ছে।’’
এনকন প্রাইভেট লিমিটেড নামে একটি সংস্থা বছরে ১ লক্ষ ৫৬ হাজার টাকার বিনিময়ে এসএসকেএম চত্বরে হোর্ডিং লাগায় এবং সেখানে একটি বেসরকারি হাসপাতালের বিজ্ঞাপন দিতে থাকে। এসএসকেএমের প্রশাসনিক ভবনের ভিতরে দেওয়াল ওই বেসরকারি হাসপাতালের বিজ্ঞাপনের ছোট পোস্টারে ছেয়ে যায়।
নথি অনুযায়ী, এদের কাছ থেকেও ২০১৩ সালে টাকা পাওয়া যায়নি। চুক্তির তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরে এরা টাকা বাড়ায়নি। কী করে সরকারি হাসপাতালের ভিতরে বেসরকারি হাসপাতালের বিজ্ঞাপন অনুমতি পায়, তা নিয়ে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আলাদা একটি তদন্ত শুরু করেছেন। এনকনের তরফে রতন মজুমদারের বক্তব্য, ‘‘আমাদের একটু মিসটেক হয়েছিল। এসএসকেএম থেকে চিঠি পেয়ে পুজোর আগে সব মিটিয়ে দিয়েছি।’’ বেসরকারি হাসপাতালের বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে অবশ্য তিনি মুখ খুলতে চাননি। চুক্তি থাকা সত্ত্বেও ২০১৪ সালে এসএসকেএমের প্রাপ্য ২ লক্ষ ৭৫ হাজার টাকা বাকি রাখার অভিযোগ উঠেছে জেকে অ্যাডভার্টাইজিং নামে একটি সংস্থার বিরুদ্ধেও। সম্প্রতি এসএসকেএম চত্বরে তিনটি খাবারের স্টল ও একটি বইয়ের দোকান বন্ধ করে দিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। জে কে অ্যাভার্টাইজিং-এর তরফে যোগেশ শাহ বলেন, ‘‘যত দূর মনে পড়ে টাকা দিয়েছিলাম। কিন্তু এসএসকেএম বলছে পায়নি। আমি কাগজপত্র ঘেঁটে দেখছি।’’ অভিযোগ, চুক্তি অনুযায়ী হাসপাতাল চত্বরে তাঁদের যে বাগান-ফোয়ারা দেখভালের কথা ছিল, তা-ও হয়নি। এ ব্যাপারে যোগেশবাবুর বক্তব্য, ‘‘ওগুলো ঠিক করলেও বারবার খারাপ হয়ে যায়। তবে পুরনো কথার আর মানে হয় না। আমি সুপারকে বলেছি, এ বার থেকে মন দিয়ে কাজ করব।’’
২০০৬ সালে স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে হাসপাতাল চত্বরে তাদের একটি এটিএম খুলতে দেওয়া হয়। বিনিময়ে হাসপাতাল চত্বরে চারটি বাগান তৈরি ও দেখভালের দায়িত্ব নেয় ব্যাঙ্কের এলগিন রোড শাখা। ঠিক হয়েছিল, বাগানের রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ ব্যাঙ্ক মাসে ১৮,৯০০ টাকা করে দেবে। কিন্তু এসএসকেএমের দাবি, সেই টাকা আসা বহু বছর বন্ধ। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষের জবাব, ‘‘পাঁচ বছর পরপর চুক্তির পুনর্নবীকরণ দরকার। কিন্তু এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ আর যোগাযোগ করেননি। তাই হয়তো টাকা দেওয়ার বিষয়টি চাপা পড়ে গিয়েছে। বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে।’’