খুনের অভিযোগে জেলবন্দি তৃণমূল কাউন্সিলর শম্ভুনাথ কাও। বাইপাসের ধারে তাঁর ৫৮ ওয়ার্ডে এ বার দলের প্রার্থী ফুলবাগান লাগোয়া ৩০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর স্বপন সমাদ্দার। প্রার্থী বদল কি মেনে নিয়েছেন তৃণমূলের স্থানীয় কর্মী-সমর্থকেরা?
ওয়ার্ড নম্বর ৬৪। এখানেও অন্য ওয়ার্ড থেকে প্রার্থী ‘হায়ার’ করে আনা হয়েছে। প্রার্থী আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের ‘জবরদস্ত’ তৃণমূল নেতা তথা ৬ নম্বর বরোর চেয়ারম্যান ইকবাল আহমেদ। তাঁকে নিয়ে দলীয় কোন্দল কতটা?
ওয়ার্ড নম্বর ৬৫। এখানেও প্রার্থী এক জন বহিরাগত। কলকাতা পুরসভার বিদায়ী বোর্ডের ডেপুটি মেয়র ফরজানা আলম তৃণমূল প্রার্থী। কর্মী অসন্তোষ কি এখানেও ভাবাবে দলকে?
এ সব প্রশ্নের জবাব খুঁজতে সকলের নজর এখন ৭ নম্বর বরোর দিকে। গত পুরভোটে এই বরোর ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল ৫টি ও বামেরা ৪টির দখল নেয়। তৃণমূলের সঙ্গে লড়াই মূলত বামেদের। এই এলাকায় বিজেপি বা কংগ্রেস এখনও ততটা আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারেনি।
একটি ওয়ার্ডে তো তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব পুরোপুরি প্রকাশ্যে চলে এসেছে। দলেরই কিছু কর্মী সমর্থকের হাতে নিগৃহীত হয়েছেন এক তৃণমূল প্রার্থীও। এ সব ঘটনায় কিছুটা অস্বস্তিতে তৃণমূল শিবির। এলাকার বিধায়ক স্বর্ণকমল সাহা অবশ্য বলছেন, ‘‘এর কোনওটা ভোটে আঁচ ফেলবে না।’’
৫৮ নম্বর ওয়ার্ডে ৬২ হাজারেরও বেশি ভোটার। সেখানে বাম প্রার্থী প্রাক্তন কাউন্সিলর লক্ষ্মীমণি বন্দ্যোপাধ্যায়। গত পুরভোটে জয়ী হন তৃণমূলের শম্ভুনাথ কাও। খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত হয়ে এখন তিনি জেলে। স্থানীয় এক বাসিন্দা সুজয় নস্করের কথায়, ‘‘ঠিক মতো পানীয় জলই পাই না। নিকাশি তো পরের ব্যাপার।’’ রাস্তাঘাট নিয়েও অজস্র অভিযোগ স্থানীয় সাহেববাগ, আড়ুপোতার বাসিন্দাদের। তা মেনে নিয়েছেন তৃণমূল প্রার্থী স্বপনবাবুও। বললেন, ‘‘ওয়ার্ডের সমস্যা নিয়ে এত দিন কিছু ভাবা হয়নি।’’ মূলত বামবোর্ডের জন্যই উন্নয়ন হয়নি বলে তাঁর দাবি।
ভোট চাইতে গিয়ে কী বলছেন? স্বপনবাবুর বক্তব্য, ‘‘এখানে এখনও অনেক কাজ বাকি রয়েছে। তৃণমূলের বোর্ড তিন কোটি টাকা খরচ করে কলকাতা শহরের প্রথম মডেল বস্তি, কমিউনিটি সেন্টার তৈরি করেছে। কিছু বস্তিতে পাকা শৌচাগার হয়েছে।’’ লক্ষ্মীমণিদেবীর প্রশ্ন, ‘‘পুর-প্রতিনিধি জেলে থাকলে কি কাজ হয়? কিছুই হয়নি পাঁচ বছরে।’’ সেখানে বিজেপি প্রার্থী প্রিয়াঙ্কা টিবরেওয়াল। আর কংগ্রেসের স্বপন ঘোষ।
৬৪ নম্বর ওয়ার্ডে গত বার তৃণমূল প্রার্থী জাভেদ আহমেদ খান হেরে যান সিপিআইয়ের ফরজানা চৌধুরীর কাছে। এ বার বাম প্রার্থীকে ‘পরাস্ত’ করতে সেনাপতি ইকবাল আহমেদ। বাম আমলেও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে নিজের ৬২ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জয়ী হন ইকবাল। এ বার ওয়ার্ডটি মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় ইকবালকে পাঠানো হয় বেকবাগান, তিলজলা জুড়ে থাকা ৬৪ নম্বরে। ফরজানা বললেন, ‘‘বুঝতেই পারছি এখানে গুন্ডাগিরি চলবে। তবে মানুষের জন্য কাজ করেছি, সততা রেখেই। ভোট অবাধ হলে ফল পাবই।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘তিন জায়গায় ভ্যাট রয়েছে। একটা কম্প্যাক্টর স্টেশন করতে অনুরোধ জানিয়েছিলাম। পুরবোর্ড করতে দিল না।’’ ইকবালের পাল্টা জবাব, ‘‘কোনও কাজ করেনি। পানীয় জল, নিকাশি, জজ্ঞাল সাফাই সবেতেই ব্যর্থ ওঁরা। এখন আতঙ্কের কথা বলে বাজার গরম করছে।’’
এলাকা ছেড়ে এখানে কেন? ইকবাল বলেন, ‘‘আমি বাইরের নই। ৬৪ নম্বর ওয়ার্ডে আমার বাড়ি রয়েছে।’’ গত বার ওই ওয়ার্ডে কংগ্রেেসর প্রার্থী হয়েছিলেন শাম্মি জাহান। একাধিক বার ওই এলাকার কাউন্সিলর শাম্মি জোর লড়াইও দেন। এ বার কংগ্রেসের প্রার্থী তনভির ইকবাল।
ফরজানার অভিযোগ, ‘‘উনি তো ডামি প্রার্থী। ইকবালেরই পক্ষে।’’ এখানে কংগ্রেস বা বিজেপি দু’দলই পিছিয়ে রয়েছে।
দীর্ঘ কাল ধরেই বামেদের দখলে ৬৫ নম্বর ওয়ার্ড। মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় বিদায়ী কাউন্সিলর সুশীল শর্মার স্ত্রী নিবেদিতা শর্মা বাম প্রার্থী। লড়াই ডেপুটি মেয়র ফরজানা আলমের সঙ্গে। ২৮ নম্বর থেকে সরিয়ে এখানে প্রার্থী করা হয়েছে ফরজানাকে। মানুষকে কী বলছেন? ফরজানার জবাব, ‘‘পানীয় জলের সমস্যা ভীষণ। জঞ্জালের পাশেই বাস করেন খালপাড়ের বাসিন্দারা। বাম আমলে কিছুই হয়নি।’’ কিন্তু গত পাঁচ বছর বোর্ড তো আপনাদের হাতে ছিল। জল সরবরাহ হয়নি কেন? মেয়র বলছেন, শহরের ৯৫ শতাংশ মানুষের কাছে পরিস্রুত পানীয় জল পৌঁছেছে। ফরজানার বক্তব্য, ‘‘মেয়র তো হাতে করে সকলের বাড়ি জল পাঠাবেন না। স্থানীয় কাউন্সিলরকেই সে ক্ষেত্রে উদ্যোগী হতে হবে।’’ নিবেদিতাদেবীর জবাব, ‘‘কাজ হয় বলেই বছর বছর বাসিন্দারা বামেদের জয়ী করেছেন।’’
৬৬ নম্বর ওয়ার্ডে এ বার নতুন মুখ মন্ত্রীপুত্র ফৈয়াজ আহমেদ খান। বাবা জাভেদ আহমেদ খান ও মা জাভেদ রাফাতের পুরনো ওয়ার্ড থেকে লড়ছেন তিনি। স্থানীয় এক বাসিন্দা নজরুল ইসলামের বক্তব্য, ‘‘পানীয় জল ও নিকাশির সমস্যা প্রবল। নিকাশির কাজ হলেও জল জমার সমস্যা রয়েই গিয়েছে।’’ জাভেদ রাফাত বলেন, ‘‘‘কাজ অনেক হয়েছে। আরও হচ্ছে।’’ স্ত্রীর বদলে পুত্রকে মনোনয়ন দেওয়া হল কেন? দমকলমন্ত্রী জাভেদ আহমেদ খানের ব্যাখ্যা, ‘‘ছেলে বড় হয়েছে। মানুষের জন্য কাজ করতে চায়। তাই দল মনোনয়ন দিয়েছে।’’ খান পরিবারের ‘পরিবারতন্ত্র’-কে কাজে লাগিয়েই প্রচারে নেমেছেন বিজেপি প্রার্থী দেবাশিস নাথ। কংগ্রেস প্রার্থী সালাউদ্দিন আহমেদের বক্তব্য, ‘‘ওঁরা কোনও কাজই করেননি।’’
উল্টো চিত্র ৫৭ নম্বরে। বেলেঘাটা খালপাড়ের উত্তর দিক থেকে শুরু এই ওয়ার্ড। বাম আমল থেকেই এলাকার হাল নিয়ে ক্ষোভ ছিল স্থানীয়দের। ইদানিং তাতে উন্নয়নের প্রলেপ পড়েছে বলে মনে করেন ক্যানাল সাউথ রোডের বাসিন্দা রিনা দলুই, পূর্ণিমা নস্করেরা। তাঁদের কথায়, প্রায় সব বড় রাস্তা সাফ হয়েছে। পিচ পড়েছে ছোট রাস্তাতেও। জঞ্জাল ফেলার মেশিন বসেছে। মথুরবাবু লেন, ক্যানাল সাউথ রোড, দেবেন্দ্রচন্দ্র রোডের খোলা নর্দমা ঢাকা দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা সুমন দাস বললেন, এক সময় পানীয় জলের হাহাকার ছিল। এখন সমস্যা অনেক কমেছে। তবে ওয়ার্ডের মাঝ বরাবর দুটো খাল বয়ে গিয়েছে, যা প্রায় পুরোটাই নোংরা-পচা জলে ভরা। তাই মশার উপদ্রব চরম। স্বীকার করে নিয়েছেন কাউন্সিলর জীবন সাহাও। বললেন, ‘‘সব সমস্যার সমাধান হয়েছে তা কখনই মনে করি না। খাল আগে আরও নোংরা ছিল। তৃণমূল এসে সংস্কার করেছে। বাকি কাজও হবে।’’ তাঁর বিরুদ্ধে সিপিএম প্রার্থী বাবলু কর। এলাকা ঘুরে দেখা গেল প্রচারে তেমন জোর নেই তাদের। তবে বামেদের সঙ্গেই মূল লড়াই তৃণমূলের। বাবলু কর এবং বিজেপি প্রার্থী সুধীর পাণ্ডে পুর-পরিষেবায় ঘাটতি নিয়ে তত সরব নন। তাঁদের অভিযোগ, মানুষ শান্তিতে ভোট দিতে পারবেন কি না তা নিয়েই সংশয় রয়েছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগও তুলছেন তাঁরা।
জীবনবাবুর জবাব, ‘‘ওয়ার্ডের মানুষ পাশে আছে। কাজের নিরিখে। ওঁরা অপপ্রচার চালিয়ে সন্ত্রাসের বাতাবতরণ সৃষ্টি করতে চাইছেন।’’
বামেরা যখন পুর-পরিষেবা নিয়ে সরব, তখন গোষ্ঠী কোন্দলে অস্বস্তিতে ৫৯ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল নেতৃত্ব। স্থানীয় নেতা রবীন বসুর স্ত্রী জলি বসু এ বার তৃণমূলের প্রার্থী। সম্প্রতি দলেরই বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর কাছে নিগৃহীত হন।
ক্ষুব্ধ রবীনবাবু বলেন, ‘‘সম্প্রতি যাঁরা সিপিএম থেকে তৃণমূলে এসেছে তাঁদের একাংশই এ কাজ করেছে।’’ তবে ভোটের মুখে নিজেদের কলহ বাড়াতে চান না জলিদেবী। তাঁর অভিযোগ, ‘‘কাউন্সিলর কোনও কাজ করেনি। তাই এলাকার মানুষ পরিবর্তন চান।’’ অন্য দিকে, বিজেপি প্রার্থী মৌমিতা ভট্টাচার্য-র অভিযোগ, ‘‘তৃণমূল কংগ্রেস সন্ত্রাসের যে বাতাবরণ তৈরি করেছে, তাতে অবাধ ভোট অসম্ভব।’’ বামেদের দখলে থাকা ওই ওয়ার্ড মহিলা সংরক্ষিত হওয়ায় এ বার সিপিএম প্রার্থী জয়শ্রী দেবনন্দী। বিদায়ী কাউন্সিলর দেবাংশু রায়ের অভিযোগ, ‘‘বতর্মান পুরবোর্ড দলীয় স্বার্থেই কাজ করেছে। যে ওয়ার্ডে তৃণমূল নেই, সেখানে কাজ করতে দেওয়া হয়নি।’’ পুর-পরিষেবাকেই হতিয়ার করে পুরভোটে এগোচ্ছেন তাঁরা— জানান জয়শ্রীদেবী।
৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর দীপালি দাস এ বারও তৃণমূলের প্রার্থী। এলাকায় পানীয় জলের সমস্যা মেনে নিয়েছেন তিনি। বিজেপির অদ্বিতীয়া মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘পুর-পরিষেবার নিরিখেই এখানে আমরা লড়াই করছি।’’
৬৩ নম্বর ওয়ার্ডে সম্প্রতি চালু হয়েছে উন্নত মানের ‘ওয়াই-ফাই’ পরিষেবা। যা নিয়ে বিজ্ঞাপনে কলকাতা ভরিয়ে দিয়েছে পুরবোর্ড। বলা হয়েছে কলকাতা ওয়াই-ফাই সিটি হয়েছে। কিন্তু পার্ক স্ট্রিটের বাইরে এখনও সেই পরিষেবা পৌঁছয়নি। বিজেপি প্রার্থী সুনীতা মিশ্র সে কথাই তুলে ধরছেন প্রচারে। বলছেন, ‘‘শুধু প্রচার করেই তৃণমূল বাজিমাত করতে চাইছে।’’ স্থানীয় কাউন্সিলর এবং এ বারের প্রার্থী সুস্মিতা ভট্টাচার্যের বক্তব্য, ‘‘জল সরবরাহ থেকে শুরু করে নিকাশি এবং জজ্ঞাল অপসারণ অনেক উন্নত।’’
কসবা ও নিউ বালিগঞ্জের কিছু এলাকা নিয়ে ৬৭ নম্বর ওয়ার্ড। কাউন্সিলর সিপিএমের দীপু দাস এ বারও প্রার্থী। বললেন, ‘‘আগের চেয়ে জল সরবরাহ এখন অনেক ভাল। একটি পুরনো জলাধার সংস্কারের অভাবে পড়ে আছে। পুরবোর্ডকে জানিয়ে ফল হয়নি।’’ পরিষেবা থেকে তার বেশি নজর ভোটের সময় সন্ত্রাসের আশঙ্কা নিয়ে। একই অভিযোগ কংগ্রেস ও বিজেপি প্রার্থী মৃণাল সরকার ও বীণা গুহঠাকুরতার। তৃণমূল প্রার্থী বিজন মুখোপাধ্যায় অবশ্য বলেন, ‘‘হারার ভয়ে ওঁরা সন্ত্রাসের অভিযোগ করছেন।’’