Mob Violence

গুজব-তাণ্ডবে ইন্ধন জোগাচ্ছে সমাজমাধ্যম, কড়া শাস্তিই কি সমাধান

থানায় অভিযোগ নেই। অথচ ছেলেধরা গুজবে উত্তাল এলাকা। পর পর ঘটছে গণপিটুনির ঘটনা। এর নেপথ্যে কী? উত্তর খুঁজল আনন্দবাজার।

Advertisement

সুনীতা কোলে

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২৪ ০৫:২০
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

১৩ জুন, বারাসতের কাজিপাড়া: বালক খুনে পাচার-চক্রের যোগ থাকার গুজবে উত্তাল এলাকা।

Advertisement

১৯ জুন, বারাসতের মোল্লাপাড়া: তরুণীকে মারধর।

১৯ জুন, বারাসতের সেন্ট্রাল মডার্ন স্কুলের বাইরে: এক তরুণী ও তাঁর আত্মীয়কে বেধড়ক গণপিটুনি।

Advertisement

২১ জুন, অশোকনগর: গণপিটুনি মানসিক ভারসাম্যহীন তরুণীকে।

২২ জুন, বনগাঁর ঠাকুরপল্লি: দুই যুবককে গণপ্রহার।

২২ জুন, খড়দহ: যুবককে মারধর।

মাত্র দিন দশেকের মধ্যে সামনে এসেছে গণপিটুনির একাধিক ঘটনা। প্রতি ক্ষেত্রেই অনুঘটক হিসাবে কাজ করেছে ছেলেধরার গুজব। সূত্রপাত হয়েছিল বারাসতের কাজিপাড়ার ঘটনা দিয়ে। নিখোঁজ বালকের দেহ উদ্ধারের পরে রটে যায়, কেটে নেওয়া হয়েছে তার চোখ ও কিডনি। পুলিশ তা নস্যাৎ করলেও গুজব থামেনি। দিনকয়েক পরেই বারাসতে গণপিটুনিতে গুরুতর জখম হন এক মহিলা ও যুবক। শিশু চুরি হয়নি বলে সাংবাদিক বৈঠকে বারাসত পুলিশ জেলার সুপারের আশ্বাস ও সচেতনতার প্রচার সত্ত্বেও গুজব বা গণপিটুনি— থামেনি কোনওটাই।

এর মধ্যে সমাজমাধ্যমে শিশুদের ছবি দিয়ে ‘নিখোঁজ’ বলে দাবি করে ঘুরছে একাধিক পোস্ট। লাইক-শেয়ারে পোস্ট ছড়াচ্ছে ঝড়ের গতিতে। অথচ, পুলিশের কাছে নেই কোনও নিখোঁজের অভিযোগ। ছেলেধরা সন্দেহে পর পর গণপিটুনির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে কেমন প্রভাব পড়ছে এমন পোস্টের?

মনোরোগ চিকিৎসক অনিরুদ্ধ দেব জানান, ক্রমাগত এমন পোস্ট দেখে আতঙ্কের সৃষ্টি হয় জনমানসে, বিশেষত অভিভাবকদের মধ্যে। তার পরে কোনও অচেনা মুখ বা কাউকে ‘সন্দেহজনক’ আচরণ করতে দেখলেই ‘কিছু একটা করা’র প্রবণতা চলে আসে। দলে ভারী হয়ে কাউকে মারধরের আশঙ্কাও বাড়ে। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘ছেলেধরা’ গল্পের প্রসঙ্গ টেনে তিনি জানাচ্ছেন, গুজব ছড়ানো বা গুজবে বিশ্বাস করার প্রবণতা মানুষের সহজাত। কিন্তু আগে যে গুজব একটি-দু’টি পাড়ায় সীমাবদ্ধ থাকত, সমাজমাধ্যমের কল্যাণে তা এখন দ্রুত বিপুল সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছচ্ছে। ফলে বাড়ছে গুজবের জেরে হিংসাত্মক ঘটনাও।

তা হলে গুজবে বিশ্বাস করে গণপিটুনি ও আরও গুজবের সৃষ্টি— এই বিষ-চক্র আটকানোর উপায় কী? অনিরুদ্ধের মতে, এর একমাত্র পথ সচেতনতা ও প্রাপ্তমনস্কতা। সমাজমাধ্যমে এমন পোস্ট খুঁটিয়ে পড়তে হবে। সত্যতা যাচাই করা না গেলে তা শেয়ার বা ফরোয়ার্ড করা থেকে বিরত থাকতে হবে। মিথ্যা গুজব ছড়ানোর ফলাফল নিয়েও ভাবতে হবে। আবার এলাকায় কারও আচরণ সন্দেহজনক ঠেকলে পরিস্থিতি বিচার করার মতো সংবেদনশীলতা থাকাও জরুরি। হতে পারে, তিনি অসুস্থ বা মানসিক ভারসাম্যহীন। এমন প্রাপ্তমনস্কতার প্রয়োগ করেই গত বুধবার বারুইপুরের ধোপাগাছিতে অ্যালঝাইমার’স-এ আক্রান্ত এক মহিলাকে মারের হাত থেকে বাঁচান স্থানীয় যুবক। তাই অনিরুদ্ধের পরামর্শ, দরকারে সন্দেহজনক ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশে জানান। কিন্তু তাৎক্ষণিক উত্তেজনায় মারধরের পথে হাঁটবেন না।

তবে, পুলিশের কাছে অভিযোগ জানাতে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে অনীহা কাজ করে বলেই জানাচ্ছেন সমাজকর্মী অরুন্ধতী ভট্টাচার্য। তাই অনেকে আইন নিজের হাতে তুলে নেন। দেখা গিয়েছে, পাচারে সিংহভাগ সময়েই জড়িত থাকে আত্মীয়-বন্ধু-প্রতিবেশীদের মতো বিশ্বাসভাজন কেউ। তাই সচেতনতার প্রচারে গিয়ে তাঁরা পরামর্শ দেন, কারও আচরণে সন্দেহ হলে দ্রুত পুলিশ-প্রশাসনকে জানান। তবে গুজবের জেরে তৃণমূল স্তরে কর্মরত কোনও সমাজকর্মীর আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা এখনও সামনে আসেনি বলেই জানান তিনি।

পর পর গণপিটুনির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের ভূমিকা কী হবে? রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন আইজি পঙ্কজ দত্ত জানান, এলাকায় নজরদারি, ঘোরাফেরা বাড়াতে হবে পুলিশকে। লক্ষ রাখতে হবে প্রাথমিক স্কুল, রেল স্টেশনে। তাতে মানুষ নিশ্চিন্ত হবেন, রটনাকারীরাও পিছু হটবে। তথ্য দিয়ে গুজব রোখার চেষ্টা চালাতে হবে। এ ক্ষেত্রে বারাসত পুলিশ জেলার ভূমিকা ও সচেতনতার প্রচার প্রশংসনীয় বলেও জানান তিনি। পাশাপাশি, গণপিটুনিতে যুক্ত ও সমাজমাধ্যমে গুজব ছড়ানোয় জড়িতদের দ্রুত চিহ্নিত করে গ্রেফতার ও কড়া শাস্তির পথে হাঁটতে হবে পুলিশকে। কঠোর আইনি ব্যবস্থা ও সচেতনতার অস্ত্রেই কমবে গুজব-দৈত্যের দাপট।

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement