শিয়ালদহের সন্তোষ মিত্র স্কোয়ার চত্বর, বৈঠকখানা বাজার সংলগ্ন এলাকা ছিল তাঁর ‘অঘোষিত’ মসনদ। ২৫ বছর ধরে কাউন্সিলর ছিলেন কলকাতা পুরসভার ওই ৫০ নম্বর ওয়ার্ডে। কংগ্রেসের ব্যানারে। এক কালে সোমেন মিত্রের স্নেহধন্য প্রদীপ ঘোষ এখন বিজেপিতে। গত বার মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় তৃণমূলের মৌসুমী দে দখল করেন প্রদীপবাবুর সাধের মসনদ। এ বারও আসনটি সংরক্ষিত। তাই মৌসুমীদেবীর বিরুদ্ধে বিজেপি প্রার্থী প্রদীপ-কন্যা কাজল ঘোষরায়। বাবার পরাজয়ের জবাব দিতে মরিয়া কাজল। আর আসন ধরে রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ মৌসুমীও।
গত বছর লোকসভা এবং চৌরঙ্গি বিধানসভা উপ-নির্বাচনের ফলাফলে পাঁচ নম্বর বরোয় দাপট ছিল বিজেপি এবং কংগ্রেসের। ১১টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৬টি ওয়ার্ডে ছিল তাদের আধিপত্য।
এ বারও কি পদ্ম ফুটবে? হাত ধরবে মানুষ? না কি তৃণমূলের অগ্রগতি অব্যাহত থাকবে? তা নিয়েই জমে উঠেছে নির্বাচনী হাওয়া। শিয়ালদহ এলাকায় গিয়ে দেখা গেল প্রচারে তৃণমূল-বিজেপি দু’পক্ষই সমানে সমানে লড়াই চালাচ্ছে।
মেয়েকে কেন? প্রদীপবাবুর জবাব, “দল মনে করে আমার পরিবার থেকে কেউ দাঁড়ালে তাঁর জেতার সম্ভাবনা বেশি। তাই এই সিদ্ধান্ত।” গত বার চৌরঙ্গি বিধানসভার উপ-নির্বাচনে ওই ওয়ার্ডে বিজেপি প্রায় সাড়ে সাতশো ভোটে এগিয়েছিল। সেটাই দলের পালে হাওয়া দেবে বলে মনে করছে বিজেপি। শুনে তৃণমূলের মৌসুমীদেবীর বক্তব্য, “ওঁরা স্বপ্ন দেখছেন দেখুন। ভোটের ফলেই বোঝা যাবে।”
অভিযোগ উঠেছে পুর-পরিষেবা নিয়েও। কাজলদেবীর অভিযোগ, এলাকার অন্যতম ফুসফুস সন্তোষ মিত্র স্কোয়ারের রক্ষণাবেক্ষণই হয় না। ঘাটতি আছে জঞ্জাল অপসারণ ও নিকাশির কাজেও। যদিও তৃণমূল কাউন্সিলর মৌসুমি দে এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
প্রার্থী পদে তৃণমূলের চমক ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডে। সেখানে তাদের প্রার্থী একদা সোমেন মিত্রের স্নেহধন্য প্রিয়াল চৌধুরীর স্ত্রী সোমা চৌধুরী। নিজের এলাকায় প্রিয়ালের স্ত্রীকে দাঁড় করাতে ওই ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর স্বপ্না দাসকে ৪০ নম্বরে সরিয়েছে তৃণমূল। এখানে বাম প্রার্থী মৌমিতা দাস এবং বিজেপির সুদীপ্তা দাস লড়াই করলেও কংগ্রেস প্রার্থী ইসমাত মেহমুদের পিছনে সোমেন বাহিনীর মদত রয়েছে।
৪০ নম্বর ওয়ার্ডের সব থেকে বড় সমস্যা কলেজ স্ট্রিট মার্কেট পুনর্গঠন। ১০ বছর পেরোলেও শেষ হয়নি কাজ। ফলে তিক্ত বইপাড়ার বাসিন্দারা। তৃণমূল কাউন্সিলর পার্থ বসুও এর সুরাহা করতে পারেননি। বিধানসভার ডেপুটি স্পিকার সোনালি গুহ’র স্বামী পার্থবাবুর ওয়ার্ড মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় এ বার তৃণমূলের প্রার্থী ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর স্বপ্না দাস। কেন অন্য ওয়ার্ডের কাউন্সিলরকে সেখানে প্রার্থী করা হল, তা নিয়ে চাপা ক্ষোভ রয়েছে এলাকায়। যদিও পার্থবাবুর কথায়, “দলের প্রার্থীর হয়েই কাজ করছি।” কংগ্রেসের প্রার্থী হয়েছেন আশা মহান্তি। ১৯৮৫ থেকে টানা ১৫ বছর কাউন্সিলর ছিলেন। বললেন, “দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলকে সরাতে চাই। কাউন্সিলর থাকাকালীন যে কাজ করেছি তার বাইরে ওয়ার্ডে কোনও কাজই হয়নি।”
৪৫ নম্বর ওয়ার্ডে এ বারও কংগ্রেসের প্রতীকে লড়ছেন কাউন্সিলর সন্তোষ পাঠক। প্রচারে এগিয়ে থাকলেও তাঁকে বেগ দিতে হাজির ১৯৯৫ সালের কংগ্রেস কাউন্সিলর নির্মলা পাণ্ডে। এ বার অবশ্য তিনি তৃণমূল প্রার্থী। লড়াই মূলত কংগ্রেস ও তৃণমূলের মধ্যে হলেও বিজেপি প্রার্থী রতন বৈদ অবাঙালি ভোট টানতে মরিয়া। স্থানীয় বাসিন্দা রাধাশ্যাম বণিক জানান, হকার সমস্যা নিয়েই অসুবিধা বেশি। সন্তোষবাবুর বক্তব্য, “পুরসভাকে বার বার বলা সত্ত্বেও সমাধান হয়নি।” হকার নিয়ে পুরসভা কোনও সুষ্ঠু পরিকল্পনা না করায় ভুগতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের দাবি সন্তোষবাবুর। নির্মলাদেবী জানিয়েছেন, পুর-পরিষেবার কাজে যে ঘাটতি, তা নিয়ে প্রচার চলছে। পরিষেবার নিরিখেই ওই ওয়ার্ডের লড়াই, এ কথা মেনে নিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী রতন বৈদ্যও।
বড়বাজারেই ৪২ নম্বর ওয়ার্ড। ২০ বছর ধরে কাউন্সিলর বিজেপি নেত্রী সুনীতা ঝাওয়ার। স্থানীয়দের একাংশের অভিযোগ, অবৈধ পার্কিং থেকে শুরু করে শৌচালয়ের অভাব রয়েছে ওয়ার্ডে। ভোটে সে সবই তুলে ধরার চেষ্টা করছেন তৃণমূল প্রার্থী প্রকাশকুমার দুগ্গার। তাঁর বক্তব্য, “এলাকার সার্বিক উন্নয়নে ব্যর্থ বিজেপি কাউন্সিলর।” সুনীতাদেবীর জবাব, “মানুষের কাজ করি বলেই আশীর্বাদ পাই। বিরোধীরা যা কিছু বলুক না কেন, এলাকার উন্নয়নই যে আমার লক্ষ্য তা জানেন ভোটারেরা।”
মহাত্মা গাঁধী রোড থেকে টেরিটি বাজার জুড়ে রয়েছে অবৈধ পার্কিং। ৪৩ ওয়ার্ডে। এ বারও প্রার্থী তৃণমূলের কাউন্সিলর শ্বেতা ইন্দোরিয়া। অবৈধ পার্কিংয়ের কথা স্বীকার করে বলেন, “অভিযান হয় প্রায়ই। তবে স্থায়ী সমাধান প্রয়োজন।” একই সমস্যা ৪১ নম্বর ওয়ার্ডেও। ফলপট্টি থেকে শুরু করে সমস্ত মেছুয়াবাজার এলাকাই পার্কিংয়ের কবলে। বেআইনিই বেশি। সিপিএম কাউন্সিলর রীতা চৌধুরি বলেন, “পার্কিং সমস্যা নিয়ে বার বার পুরসভাকে জানিয়েও লাভ হয়নি।” তবে জঞ্জাল অপসারণ আগের চেয়ে ভাল বলে তাঁর দাবি।
৪৪ নম্বর ওয়ার্ডের মূল সমস্যা পুরনো রাস্তা। অভিযোগ, ওই সব জীর্ণ পথে প্রায়ই ধস নামে। স্থানীয় বাসিন্দা মহম্মদ আসলােমর অভিযোগ, বেআইনি বাড়ির আধিক্য আছে এখানে। গত পুরভোটেই সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে যোগ দেন কাউন্সিলর রেহানা খাতুন। এ বারও তিনিই তৃণমূলের প্রার্থী। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই ওয়ার্ডের পুর-নির্বাচনে পাল্লা দিয়ে লড়ছে বিজেপি। তাদের প্রার্থী কপিলদেব জায়সবাল। পিছিয়ে নেই কংগ্রেসের মহম্মদ ইমরান খান। পুর পরিষেবায় খামতির জবাবে রেহানার দাবি, রাস্তা এখন ভাল। তবে কোথাও কেথাও বেআইনি নির্মাণ রয়েছে। জানতে পারলে ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
পুরনো কলকাতার ৪৮ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে ‘বিপজ্জনক’ বাড়ি। কিছু দিন আগেই প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিটে বাড়ি ভেঙে পড়ে। শ্রী গোপাল মল্লিক লেনের বাসিন্দা সুনন্দ রায়ের অভিযোগ, “পুরনো বাড়ি নিয়ে পুরসভা কোনও ব্যবস্থা নেয়নি।” জবাবে তৃণমূল কংগ্রেস কাউন্সিলর এবং এ বারের প্রার্থী সত্যেন্দ্রনাথ দে বলেন, “বাড়ির মালিকদের চিঠি দিয়ে ব্যবস্থা নিতে জানানো হয়েছে। কিন্তু তাঁরা কোনও ব্যবস্থা নেননি।” লড়াইয়ের মাঠ ছাড়তে রাজি নন কংগ্রেস প্রার্থী পম্পা দত্তও।
৩৬ ওয়ার্ডে বস্তি উন্নয়ন নিয়ে উঠেছে নানা অভিযোগ। এ বারও প্রার্থী সিপিআইয়ের কাউন্সিলর মৌসুমি ঘোষ। তাঁর জবাব, “সময় মতো প্রয়োজনীয় টাকা না দেওয়ায় বস্তির কাজ দেরিতে শুরু হয়েছে।” দীর্ঘ কাল ধরে ওই ওয়ার্ড বামেদের দখলে। এ বার সেখানে তৃণমূলের প্রার্থী হয়েছেন রাজেশ খন্না। প্রচারে বাম প্রার্থীকে ছাপিয়ে গেলেও ভোট-যুদ্ধে কতটা জমি দখল করতে পারেন, দেখতে আগ্রহী রাজাবাজার ও বেলেঘাটার একাংশের বাসিন্দারা।
সূর্য সেন স্ট্রিটের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা এখনও মুছে যায়নি শিয়ালদহের মানুষের মন থেকে। ভোটের আগে তাই বৈঠকখানা বাজারের অগ্নি-নির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন স্থানীয় বাসিন্দা প্রীতম সামন্ত। তৃণমূল কাউন্সিলর স্বপ্না দাস জানান, “এটি অবশ্যই সমস্যা। এই বরোর চেয়ারম্যান তথা ৪৯ নম্বর সূর্য সেন স্ট্রিট সংলগ্ন ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অপরাজিতা দাশগুপ্তের ‘ঘর শত্রু’ তাঁর নিজের ভাইঝি, কংগ্রেস প্রার্থী মোনালিসা বন্দ্যোপাধ্যায়। অপরাজিতার কথায়, “নিজস্ব রাজনৈতিক মতামত থাকতেই পারে। তাতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক সম্পর্ক ক্ষুণ্ণ হতে যাবে কেন?” একই সুর মোনালিসার গলাতেও। ভোেটর প্রচারে তাঁর হাতিয়ার কি পিসির বিরুদ্ধাচারণ? উত্তর, ‘‘না। তবে, অবশ্যই আরও উন্নয়ন।’’