Sex Workers

যৌনতাকে শ্রমের স্বীকৃতি সুপ্রিম কোর্টের, রায় মেলার এক বছর পরেও সুখ নেই সোনাগাছির ‘লাল’ গলিতে

২০২২ সালে যৌনপেশা আইনসম্মত বলে রায় দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট। ফি বছর শ্রমিক দিবসে শ্রমিকের মর্যাদার দাবি ওঠে যৌনকর্মীদের মিছিল থেকে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলেছে কি?

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ০১ মে ২০২৩ ১৫:৫৮
Share:

দিন যায়। দিন বদলায় কি! ছবি: সংগৃহীত।

যৌনকর্মকে পেশার স্বীকৃতি দিতে হবে। এমন দাবি দীর্ঘ দিনের। এক বছর আগে ২০২২ সালের মে মাসে সেই স্বীকৃতি মিলেছিল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে। সর্বোচ্চ আদালত জানিয়ে দিয়েছিল, আর পাঁচটা পেশার মানুষের মতো যৌনকর্মীদেরও সমমর্যাদা ও সমান অধিকার রয়েছে। একই সঙ্গে এই পেশায় আসা কর্মীদের কাজে অহরহ পুলিশি হস্তক্ষেপ এবং ফৌজদারি মামলা দায়েরের প্রবণতাতেও লাগাম পরিয়েছিল আদালত।

Advertisement

খুশিতে ফেটে পড়েছিল এশিয়ার বৃহত্তম যৌনকর্মীদের পাড়া সোনাগাছি। গোটা রাজ্যেই আবির খেলেছিলেন যৌনকর্মীরা। কিন্তু এক বছর পরে তাঁরা বুঝেছেন, ওই রায়ে দিন বদলায়নি। কলকাতায় কিছুটা কম হলেও এখনও যৌনকর্মীদের সামাজিক ও প্রশাসনিক লাঞ্ছনার মুখে পড়তে হচ্ছে। আর অনেক দিন ধরে তোলা শ্রমিকের মর্যাদা পাওয়ার দাবি এখনও অধরাই রয়ে গিয়েছে। ১ মে, শ্রমিক দিবসের দিনেও সেই অধরা স্বপ্নের কথা কলকাতার যৌনকর্মীদের মুখে।

‘গতর খাটিয়ে খাই, শ্রমিকের মর্যাদা চাই’— স্লোগানে প্রথম বার কলকাতা মুখরিত হয়েছিল ২০০১ সালের ৩ মার্চ। কলকাতার রাস্তায় প্রথম বার, পঁচিশ হাজার যৌনকর্মী মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন। ‘ইন্টারন্যাশনাল সেক্স ওয়ার্কারস ডে’ উপলক্ষে সেই মিছিলের পরে প্রতি বারই শ্রম দিবসের আগে-পরে মিছিল করেন কলকাতার যৌনকর্মীরা। রবিবার বিকেলে সেই মিছিলের উদ্যোগ থাকলেও বৃষ্টির কারণে তা ভেস্তে যায়। তবে নিজেদের দাবি নিয়ে সরব হয়েছেন তাঁরা। এক বছর আগে সুপ্রিম কোর্টের রায় জানা গেলেও সরকারি কোনও ব্যবস্থা কেন হচ্ছে না, সেই প্রশ্ন তুলে এ বার কলকাতায় বড় কর্মসূচি নিতে চলেছে রাজ্যে যৌনকর্মীদের প্রধান সংগঠন দুর্বার মহিলা সমন্বয় কমিটি। আগামী জুন মাসে কলকাতায় জড়ো হবেন দেশের বিভিন্ন রাজ্যের যৌনকর্মীরা। সংস্থার মুখপাত্র মহাশ্বেতা মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট শ্রমের মর্যাদা দিয়ে যৌনপেশাকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে। কিন্তু এক বছর পার হয়ে গেলেও এই পেশার কর্মীরা কোনও বাড়তি সুবিধাই পান না। এখনও তাঁদের কাজের নির্দিষ্ট সময় ঠিক হয়নি। গোটা দেশেই সরকারি উদ্যোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে আমরা তিন দিনের কর্মসূচি নিতে চলেছি আগামী জুন মাসে।’’

Advertisement

প্রসঙ্গত, গত বছর ২৬ মে বিচারপতি এল নাগেশ্বর রাওয়ের নেতৃত্বাধীন সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চ বলে, ‘‘যৌনকর্মীরাও আইনের চোখে সমান সুরক্ষার অধিকারী। যখন এটা স্পষ্ট যে, যৌনকর্মী এক জন প্রাপ্তবয়স্ক এবং সম্মতি সাপেক্ষেই যৌনতা বিক্রি করছেন, তখন পুলিশকে অকারণ হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকতে হবে। কোনও ফৌজদারি ব্যবস্থাও গ্রহণ করা যাবে না। সংবিধানের ২১ নম্বর অনুচ্ছেদ এই দেশের প্রত্যেক নাগরিকের মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার সুনিশ্চিত করেছে।’’

আদালত এটাও জানিয়ে দেয় যে, মা যৌনপেশায় আছেন যুক্তি দেখিয়ে সন্তানকে তাঁর মায়ের থেকে সরিয়ে নেওয়া যাবে না। পাশাপাশি, কোনও যৌনকর্মী যদি তাঁর বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের অভিযোগ নিয়ে পুলিশের কাছে যান, তা হলে সেটিও সমান মনোযোগের সঙ্গে দেখবে পুলিশ। বিশেষত, যদি যৌনকর্মী তাঁর বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থা বা অপরাধের অভিযোগ নিয়ে আসেন, তা হলে দ্রুততার সঙ্গে তাঁর শারীরিক পরীক্ষা করে তদন্ত শুরু করতে হবে। এ ক্ষেত্রে, এক জন সাধারণ মানুষ যেমন সুবিধার অধিকারী, যৌনকর্মীদের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা করা যাবে না। কোনও ঘটনা ঘটলে যৌনকর্মীদের পরিচয় যেন প্রকাশ্যে না আসে, সে ব্যাপারেও স্পষ্ট নির্দেশিকা দিয়েছে আদালত। একই সঙ্গে আদালত বলে, যৌনপল্লিতে পুলিশি অভিযানের সময় যৌনকর্মীদের গ্রেফতার, দণ্ডিত করা, হেনস্থা করা উচিত নয়। কারণ যৌনকর্ম বেআইনি নয়, শুধুমাত্র যৌনপল্লি চালানো বেআইনি।

কলকাতারই যৌনকর্মী বেলা দাস (নাম পরিবর্তিত) বলেন, ‘‘আসলে আইনের ফাঁক রয়ে গিয়েছে। যৌনকর্ম বেআইনি নয় কিন্তু যৌনপল্লি চালানো যেহেতু আইনি নয়, তাই হামেশাই হেনস্থার শিকার হতে হয়।’’ আর এক যৌনকর্মী প্রিয়ঙ্কা সাউ (নাম পরিবর্তিত) বলেন, ‘‘আমাদের পেশাকে আইনি বলে তো কোনও লাভ নেই। আমাদের শ্রমিকের মর্যাদা দিতে হবে। আমাদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে পেনশনের ব্যবস্থা করা দরকার। কাজের সময় নির্দিষ্ট করা থেকে, মাতৃত্বকালীন সুবিধা এবং বার্ধক্য ভাতার নির্দিষ্ট আইন করা দরকার। সেটা না হলে কোনও লাভ হবে না। এটা না থাকার জন্য পেট আর সংসার চালাতে অনেক মেয়েকেই গর্ভবতী অবস্থায় কাজ করে যেতে হয়। তার ফলেও অনেকের ক্ষেত্রেই মারাত্মক হয়। আমরা সরকারি চিকিৎসা বিমার সুবিধাও পাই না।’’ যৌনকর্মীদের আরও কিছু দাবি দাওয়া রয়েছে। তার মধ্যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা যেমন রয়েছে, তেমনই ন্যূনতম মজুরি, আইনি সুরক্ষার দাবিও রয়েছে।

দুর্বারের দাবি, দেশের কোথাওই এই সংক্রান্ত নিয়মকানুন ঠিক মতো কার্যকর হয়নি। অভিযোগ, এই রাজ্যে ১৯৯৭ সালে যৌনকর্মীদের কো-অপারেটিভ গঠিত হয়েছে। তার পরেও আইনি সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত বাংলার লক্ষ লক্ষ যৌনকর্মী। ছবিটা কলকাতার সঙ্গে আলাদা নয় বাগনান কিংবা কোচবিহারে। রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় যৌনপল্লি তুলে দিয়ে বহুতল বানানোর চেষ্টা চলছে বলেও অভিযোগ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement