উত্তপ্ত আরজি কর হাসপাতাল। —ফাইল চিত্র।
নবান্নের ‘অদ্ভুত ফরমান’ শুনে যেন ফুঁসছেন অভিনেত্রী, নাট্যকর্মী সুদীপ্তা চক্রবর্তী। ‘‘এর পরে বলবে, মেয়েদের কাজই করা উচিত নয়। তার পরে বলবে, মেয়েদের বেডরুম থেকে বেরোনো উচিত নয়। এবং বেডরুমেই ধর্ষণ হবে। শেষে বলবে, মেয়েদের জন্মানোই উচিত নয়। অর্থহীন কথাবার্তা!’’ তাঁর প্রশ্ন, ‘‘আমার রাতে শুটিং থাকলে কী করব? যাত্রার অভিনেত্রীরা সারা রাত যাতায়াত করা বা রাতভর শো করা কি তবে বন্ধ রাখবেন? রাতে কোনও মহিলার প্রসববেদনা হলে তিনি হাসপাতালে মহিলা ডাক্তার, নার্স পাবেন না?’’
কলকাতা, বাংলা ছাড়িয়ে সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়া রাতদখল অভিযানের কথা যাঁর ফেসবুক পোস্টে উঠে এসেছিল, সেই রিমঝিম সিংহও রবিবার বলছিলেন, ‘‘মেয়েদের নাইট ডিউটি বন্ধ করতে বলা তো মধ্যযুগে ফেরারই চেষ্টা। না, আমরা কেউ এর জন্য রাতদখল করতে পথে নামিনি।’’ রিমঝিম তাই মনে করছেন, মেয়েদের তরফে আন্দোলনের চাপটা এখনও রাখতেই হবে।
২০০৫ সাল থেকেই এ দেশে কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের অংশীদারি কমছে। পশ্চিমবঙ্গে ছবিটা আরও করুণ। এই পটভূমিতে আর জি কর-কাণ্ডের জেরে মেয়েদের নাইট ডিউটি যত দূর সম্ভব কমানোর ভাবনা উল্টে আত্মঘাতী বলে ধরছেন সমাজের নানা ক্ষেত্রের মানুষজন। ‘সেক্টর ফাইভ স্টেকহোল্ডার্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর ভাইস প্রেসিডেন্ট তথা প্রবীণ তথ্যপ্রযুক্তি কর্তা কল্যাণ কর যেমন বলছেন, ‘‘সেক্টর ফাইভের ১২০০ তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থার মধ্যে ৫০ শতাংশই বিপিও, কল সেন্টার। সেখানে রাতে মেয়েদের ভূমিকাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। রাতে মেয়েদের কাজ করানো যাবে না বা কাজ করানো ভাল নয়, এই বার্তা গেলে সার্বিক ভাবেই কাজের সুযোগ কমবে। আমেরিকা, ইউরোপের সময় বা আন্তর্জাতিক কর্ম সংস্কৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাতে কাজ করতেই হবে।’’ তবে কল্যাণ বলছেন, ‘‘রাতের কাজের পরিবেশ সুরক্ষার জন্য রাজ্য সরকারের প্রস্তাব সব সময়েই স্বাগত। কিন্তু তার মানে কাজ বন্ধ করা নয়।’’
নারী দিবস উদ্যাপন মঞ্চের তরফে সমাজকর্মী রত্নাবলী রায়েরও প্রশ্ন, ‘‘মেয়েদের নাইট ডিউটি নিয়ে এমন পরিকল্পনা একতরফা ভাবে কী ভাবে চাপাতে পারে রাজ্য? নারী অধিকার রক্ষা কর্মীদের সঙ্গে কেন আলোচনা করা হয়নি? এই ফরমান প্রত্যাহার করতে হবে।’’ ওই মঞ্চ মনে করে, ‘‘চিকিৎসক, নার্স, আশাকর্মী, অনলাইন সরবরাহকর্মী, সাংবাদিক, সমাজকর্মী-সহ নানা পেশায় রাতেও মেয়েদের কাজ করা একান্ত প্রয়োজন। রাতের ডিউটি সরকার নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে এই ধরনের পেশায় মেয়েদের প্রতি বৈষম্য আরও বাড়বে।’’
অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, ট্রাস্টিদের অ্যাডভাইজ়র (আউটরিচ) পরমা রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘সাংবাদিক বা তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী হিসাবে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতায় জানি, গুরুত্বপূর্ণ কাজের সময়ে দিন, রাতের ফারাক থাকে না। রাতে কাজ করা যাবে না বলাটা মেয়েদের প্রতি বৈষম্যেরই নামান্তর।’’ তবে মেয়েদের সুরক্ষায় গাড়িতে করে নিয়ে আসা, নিয়ে যাওয়ার মতো নানা পদক্ষেপ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির তরফে জরুরি বলেও তিনি মনে করেন।
রাজ্যের শাসকদলের ট্রেড ইউনিয়নের সর্বভারতীয় সভানেত্রী দোলা সেন কিন্তু বলছেন, ‘‘এত গেল-গেলর কিছু হয়নি। পাট, চা কিংবা বিড়ি শিল্পেও মেয়েদের রাতে কাজ করতে হয় না। যে সব ক্ষেত্রে মেয়েদের নাইট ডিউটি করতে হয়, তাঁদের সুরক্ষার জন্য মুখ্যমন্ত্রী কিছু পদক্ষেপ করেছেন। এর মানে তিনি মেয়েদের নাইট ডিউটির বিরোধী নন।’’