—প্রতীকী চিত্র।
বলা হয়েছিল, মাস ছয়েক লাগবে। অথচ, কেটেছে ছ’বছর। এত দিন কাঠের বাক্সে কফিনবন্দি শবের মতোই পড়ে আছে সতেরো, আঠারো, উনিশ শতকের সব বই। সব থেকে পুরনো নথিটি ১৪ শতকের।
এশিয়াটিক সোসাইটির সংগ্রহের লক্ষাধিক গ্রন্থ লালবাজারের কাছে কারেন্সি বিল্ডিংয়ে উইয়ের খাদ্য হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। দিল্লির সংস্কৃতি মন্ত্রককে বার বার জানিয়েও বই-পুনর্বাসনের সূত্র মেলেনি বলে জানাচ্ছেন এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃপক্ষ। আবার পড়ে থাকা বিপুল গ্রন্থ ঝেড়ে-বেছে ডিজিটাইজ় কেন করা হচ্ছে না, কারও কাছে তারও সদুত্তর নেই।
সোসাইটির প্রাক্তন প্রকাশনা সচিব রামকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, কারেন্সি ভবনে ইউরোপীয় এবং ভারতীয় ভাষার নানা বই বাক্সবন্দি। তার মধ্যে আইজ্যাক নিউটনের সময়ের ব্রিটেনের রয়্যাল সোসাইটির জার্নাল ‘ফিলজ়ফিক্যাল ট্র্যানজ়্যাকশন’-এরও কিছু সংখ্যা আছে। তরুণ নিউটনের লেখা বিজ্ঞান বিষয়ক কিছু পেপার ওই জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল।
এ ছাড়া, আঠারো শতকে ব্রিটিশ আলোকায়ন বা এনলাইটেনমেন্ট-এর ফসল লিনিয়ান সোসাইটির প্রাকৃতিক ইতিহাস বা জীববিদ্যা বিষয়ক নানা প্রকাশনাও কার্যত গুদামবন্দি। রয়েছে উনিশ শতকের বেশ কিছু মেডিক্যাল জার্নাল বা তৎকালীন ভারতের পশুপক্ষী, জীবজগৎ বিষয়ক গ্রন্থও।
রামকৃষ্ণের কথায়, “হাজারখানেক বাক্সে থাকা এক লক্ষ ছ’হাজার বইয়ের সবই সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু কিছু অমূল্য। কয়েকশো বছরের পুরনো বইগুলি প্রকাশনার ইতিহাস চর্চাতেও গুরুত্বপূর্ণ।”
বইমেলায় বই নিয়ে বিপুল উদ্যাপনের শহরে বইয়ের উদ্বাস্তু হওয়ার ঘটনাটিতে ব্যথিত এশিয়াটিক সোসাইটির সদস্য, গবেষকেরা। কারও কারও মত, বিজ্ঞান বা ডাক্তারি শাস্ত্র চর্চার ইতিহাস জানতে বইগুলি জরুরি দলিল।
বছর কুড়ি আগে স্ট্র্যান্ড রোডের মেটকাফ হলে প্রথমে এশিয়াটিক সোসাইটির বর্ধিত গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। সেখানেই বইগুলি ছিল। মেটকাফ হল থেকে বইগুলি সরানোর পরে এখন কলকাতার ইতিহাস বিষয়ক একটি প্রদর্শনী খোলা হয়েছে। কিন্তু নির্বাসিত বইগুলি যাবে কোথায়?
এশিয়াটিক সোসাইটির প্রেসিডেন্ট স্বপন প্রামাণিক বলছেন, “কারেন্সি বিল্ডিংয়ে বইগুলি রাখে আর্কিয়োলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া (পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বা এএসআই)। সংস্কৃতি মন্ত্রককে বইগুলির বিষয়ে অনেক চিঠি লিখেছি। কয়েক মাস আগে সংস্কৃতি সচিব বলেনও, বইগুলির বিষয়ে আমাদের সঙ্গে এএসআই-কে উনি আলোচনায় বসাবেন। কিন্তু ব্যাপারটা আটকে।” এশিয়াটিক সোসাইটির অন্দরেই প্রশ্ন উঠছে, গুরুত্বপূর্ণ বইগুলিকে চিহ্নিত করে ডিজিটাল নথি কেন তৈরি হচ্ছে না? তা হলে ভঙ্গুর হতশ্রী বইগুলি সদস্যেরা ওয়েবসাইটেই দেখতে পেতেন।
কোনও সুস্পষ্ট পরিকল্পনা ছাড়াই ন্যাশনাল মিউজ়িয়ামের বিপুল পুরাসামগ্রী দিল্লিতে সরাতে চেয়েছিল কেন্দ্র। রাজ্যসভার সাংসদ জহর সরকার বিষয়টি নিয়ে সরব হন। পরে অবশ্য অমূল্য পুরাবস্তুতে হাত দেওয়া থেকে পিছিয়ে আসে কেন্দ্র। এশিয়াটিক সোসাইটির আজীবনের সদস্য জহর বই রাখার স্থানাভাব নিয়ে ওয়াকিবহাল। তিনি মনে করেন, “বাক্সবন্দি বইগুলি বেছে ডিজিটাইজ় করা উচিত।”
সোসাইটির তরফে স্বপন বলছেন, ‘‘কারেন্সি বিল্ডিংয়ের বইয়ের তালিকা তৈরি করানো হলেও অমূল্য বইগুলি বাছাই করা হয়নি। তা ছাড়া, বই, পুঁথি ডিজিটাইজ় করার কাজ একটানা চলছে। সুযোগ এলে ওই বইগুলিরও ডিজিটাল নথি হবে।” কবে? স্পষ্ট জবাব নেই। বাক্সবন্দি বইগুলির দশা নিয়েও শঙ্কার কাঁটা। কেউ কেউ মনে করেন, বই ডিজিটাইজ় করায় গড়িমসির মধ্যে এক ধরনের সঙ্কীর্ণতারই প্রকাশ।