রূপঙ্কর বসু
স্কুলে ধুমধাম করে সরস্বতী পুজো হবে। তার পরেই ফ্রায়েড রাইস-চিলি চিকেন, জম্পেশ খাওয়াদাওয়া। সব চলছিল ঠিকঠাক। হঠাৎ স্কুলে খবর এল, সপ্তম শ্রেণির ফার্স্ট বয় রূপঙ্কর বসুর ব্লাড ক্যানসার ধরা পড়েছে। কেমোথেরাপি করতে হবে। খরচ অনেক। কিন্তু রূপঙ্করদের তো বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা মুদির দোকান ছাড়া কিছুই নেই। কী হবে!
একাদশ শ্রেণির যে ছাত্রেরা এ বার সরস্বতী পুজোর দায়িত্বে, তারাই দিল প্রস্তাবটা। এখনই চাঁদা তুলে এত টাকার ব্যবস্থা করা অসম্ভব, ঠাকুরও বায়না দেওয়া হয়ে গিয়েছে। তাই পুজো হোক নমো নমো করে। খাওয়া-দাওয়া, আলো, অনুষ্ঠান বৈভব সব বাদ। পুজোর চাঁদা বরং খরচ হোক রূপঙ্করের চিকিৎসায়। উঁচু শ্রেণির দাদাদের প্রস্তাবকে সমর্থন করে খুদে পড়ুয়ারাও। বুধবার এ ভাবেই দত্তপুকুরের মহেশ বিদ্যাপীঠের সরস্বতী পুজোর চাঁদার টাকায় শুরু হল স্কুলেরই এক ছাত্রের চিকিৎসা।
স্কুল সূত্রের খবর, ১১ জানুয়ারি স্কুলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতার দিনই রূপঙ্করের শরীর খারাপ হয়। সন্ধ্যার পর থেকে ধুম জ্বর, গায়ে চাকা-চাকা দাগ দেখা যায়। স্থানীয় চিকিৎসক ডেঙ্গি-পরীক্ষা করাতে বলেন। রক্ত পরীক্ষা করে জানা যায়, প্লেটলেট ১৮ হাজার, হিমোগ্লোবিন ৭-এরও কম। পরের দিনই রূপঙ্করকে নিয়ে যাওয়া হয় বিধানচন্দ্র রায় হাসপাতালে। জানা যায়, রক্তে ক্যানসার হয়েছে ওই ছাত্রের। ১৪ জানুয়ারি তাকে ভর্তি করা হয় রাজারহাটের টাটা মেমোরিয়াল ক্যানসার হাসপাতালে। সেখান থেকে জানানো হয়, ২১ দিনের মধ্যে পরপর ১০টি কেমোথেরাপি করতে হবে এবং প্লেটলেটও দিতে হবে। খরচ প্রায় ৯ লক্ষ টাকা।
রূপঙ্করের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, তার বাবা কৃষ্ণেন্দু বসু নিজেই রোগগ্রস্ত, ঠিক মতো নড়াচড়া করতে পারেন না। কোনও মতে বাড়ির সামনে মুদির দোকানটা সামলে সংসার চালান তিনি। একমাত্র ছেলের এমন রোগ ও খরচের কথা জানতে পেরে ভেঙে পড়েছে পরিবার। বুধবার সেই দুঃসংবাদ পৌঁছয় স্কুলেও। চাঁদা তুলে কিছু একটা ব্যবস্থা করার প্রস্তাব দেন শিক্ষকেরা। কিন্তু সরস্বতী পুজোর দায়িত্বে থাকা একাদশ শ্রেণির ছাত্রদের মধ্যে থেকে দেবজ্যোতি দত্ত বলে ওঠে, ‘‘এখনই অন্তত লাখখানেক টাকা লাগবে। চাঁদা তোলারও সময় নেই। সরস্বতী পুজো কাটছাট করে ওই চাঁদাই দিয়ে দেওয়া হোক।’’ আরও এক ছাত্র পাপ্পু দাস বলে, ‘‘ফ্রায়েড রাইস, চিলি চিকেন আমরা পরের বছর রূপঙ্করকে সঙ্গে নিয়েই খাব। ছোট ভাইটা কষ্ট পাচ্ছে, ওই খাবার আমাদের গলা দিয়ে নামবে না।’’ অজয় মণ্ডল বলে, ‘‘পরে না হয় আরও টাকার ব্যবস্থা করতে প্রয়োজনে পথে নামব, কী বলো অন্য ক্লাসের ভাইয়েরা?’’— একযোগে সম্মতি জানায় সকলে। ১৩৫০ জন ছাত্রের কাছ থেকে ৭০ টাকা করে চাঁদা নিয়ে এ দিনই ৫০ হাজার টাকা তুলে দেওয়া হয় রূপঙ্করের জ্যাঠতুতো দাদা শুভঙ্কর বসুর হাতে।
তার ঠিক কী হয়েছে, জানে না রূপঙ্কর। মা মিতাদেবীর ফোনে শুভঙ্করের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিতে স্কুল থেকে ঘন ঘন শিক্ষকদের ফোন আসছিল। এ দিন সন্ধ্যায় রাজারহাটের ওই হাসপাতালে টাকাটা পৌঁছে দেওয়ার পরে তা হাতে নিয়ে মিতাদেবী অঝোরে কেঁদে গিয়েছেন। শুধু বলেছেন, ‘‘আহা রে! এতগুলো ছেলেমেয়ের একসঙ্গে পাত পেড়ে খাওয়া হল না!’’ সামনেই বার্ষিক পরীক্ষা। তাই হাসপাতাল থেকে কবে ছুটি হবে সেই প্রশ্নই মাকে বারবার করছে রূপঙ্কর। শরীরে প্রচণ্ড যন্ত্রণা, তবুও হাতে ধরা রয়েছে ইংরেজি বইটা। স্কুলের শিক্ষক অলোক জানা শুভঙ্করকে ফোনে অভয় দিয়ে বলেছেন, ‘‘পরীক্ষা নিয়ে চিন্তা করিস না, ক’দিন না পড়লেও তুই ঠিক ফার্স্ট হবি। তাড়াতাড়ি সেরে ওঠ।’’
শিক্ষক ও পরিচালন সমিতি ঠিক করেছে, পুজোর বাকি চাঁদার সঙ্গে শিক্ষকেরা টাকা মিলিয়ে শনিবারের মধ্যে আরও ৫০ হাজার টাকা দেওয়া হবে রূপঙ্করের পরিবারের হাতে। এগিয়ে এসেছেন বহু অভিভাবকও। এখনও লাগবে আরও অনেক টাকা। প্রধান শিক্ষক অলোক অধিকারীর প্রতিক্রিয়া, ‘‘ছাত্রদের দেখে গর্বে মনটা ভরে উঠছে। প্রাক্তন ছাত্রদেরও জানাব। আমাদের সবাই মিলে রূপঙ্করকে স্কুলে ফেরাতেই হবে।’’