কুণ্ডলী: শহরের বহু গাছের সঙ্গে এ ভাবেই জট পাকিয়ে রয়েছে তার। মঙ্গলবার, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া স্ট্রিটে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
ঝড় হলেই অবধারিত ভাবে ওঠে প্রশ্নটা। আর ঝড়ের রেশ কেটে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেটে যায় প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার চাপ। অভিযোগ, দায়িত্ব মেনে নিয়ে দ্রুত পদক্ষেপ করার তৎপরতা ঝেড়ে ফেলা হয়। বদলে শুরু হয় সেই চেনা দায় ঠেলাঠেলি।
যা আবারও দেখা গিয়েছে সোমবার, মরসুমের প্রথম বড় কালবৈশাখীর জেরে ছিঁড়ে পড়া তার সরানোর ক্ষেত্রে। অভিযোগ, শহরকে তারের জটমুক্ত করতে প্রশাসন যে নিষ্ক্রিয়, তা-ই আবার প্রমাণ হয়েছে ওই দিন। গত কয়েক বছরে একের পর এক ঘূর্ণিঝড় কলকাতায় আছড়ে পড়ার পরে যে দৃশ্য দেখা গিয়েছিল, সোমবার সন্ধ্যায় তার ব্যতিক্রম বিশেষ হয়নি। বহু জায়গায় গাছ পড়ে রাস্তা বন্ধ। অনেক এলাকা বিদ্যুৎহীন। পুলিশ এবং দমকল হিমশিম খাচ্ছে গাড়ির মাথায় ভেঙে পড়া গাছের ডাল সরাতে। সব চেয়ে নাজেহাল অবস্থা তারের জট নিয়ে। কোনটা কেব্লের, কোনটা বিদ্যুতের— বুঝে ওঠা যাচ্ছে না। ভেঙে পড়া গাছের সঙ্গে এমন ভাবে তার জড়িয়ে যে, বেকায়দায় টানতে গেলে বিপদ বাড়তে পারে আরও। রাতের দিকে পুলিশ-প্রশাসন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পারলেও আরও এক বার প্রশ্ন উঠল, মাকড়সার জালের মতো ছড়িয়ে থাকা তারের জট শহর থেকে সরবে কবে?
দৃশ্যদূষণ ঠেকাতে এবং বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হওয়ার ঘটনা আটকাতে তারের জট সরাতে উদ্যোগী হয়েছিলেন প্রাক্তন মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়। ২০১৫ সালে এ নিয়ে কেব্ল অপারেটর এবং মাল্টি সিস্টেম অপারেটরদের (এমএসও) সঙ্গে বৈঠক হয় তাঁর। কিন্তু অভিযোগ, এত বছরেও সবটাই রয়ে গিয়েছে আলোচনার পর্যায়ে। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও জানিয়েছিলেন, গ্রিন সিটি প্রকল্পের আওতায় রাজ্যের ১২৬টি পুরসভা ও ছ’টি পুর নিগম এলাকায় মাটির নীচ দিয়ে কেব্ল নিয়ে যাওয়ার কাজ করা হবে। কিন্তু ওই কাজ শুরু হয়েছে শুধুমাত্র হরিশ মুখার্জি রোডে। শহরের বাকি অংশে সবই রয়ে গিয়েছে আগের মতো।
ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, মূলত বস্তি এলাকায় তারের জট মাথায় নিয়েই বিপদের প্রহর গোনেন বাসিন্দারা। কলকাতা শহরে নথিভুক্ত এবং অ-নথিভুক্ত বস্তির সংখ্যা খুব কম নয়। দমকলের দীর্ঘ দিনের অভিযোগ, বৃষ্টির জল তারের স্তূপ বেয়ে মিটার ঘরে ঢুকে অগ্নিকাণ্ড ঘটায়। সঙ্কীর্ণ গলিপথের ঘিঞ্জি বস্তি এলাকায় আগুন লাগলে তা নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। আশঙ্কা থাকে প্রাণহানিরও। আর ঝড়বৃষ্টি হলে এর সঙ্গেই তৈরি হয় তারের জট নিয়ে ভেঙে পড়া গাছ বা খুঁটির বিপদ। কোনটা বিদ্যুতের তার আর কোনটা অন্য তারের খুঁটি, বোঝা যায় না কিছুই। অভিযোগ, বিদ্যুতের খুঁটিগুলির যা ধারণক্ষমতা, তারের বোঝা তার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। একই খুঁটিতে কেব্ল এবং ইন্টারনেটের তারও জড়ানো থাকে। ফলে সামান্য ঝড়ে খুঁটি উপড়ে আসে। প্রতি বর্ষায় ছেঁড়া তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ঘূর্ণিঝড় আমপানেও শহরে সব চেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েই।
পুর আধিকারিকেরা জানাচ্ছেন, শহরে পুরসভার তিন লক্ষেরও বেশি খুঁটি রয়েছে। এ ছাড়াও আছে কেএমডিএ এবং সিইএসসি-র খুঁটি। কিন্তু এক-একটি খুঁটিতে ধারণক্ষমতার কয়েক গুণ বেশি কেব্ল, ইন্টারনেট এবং বিদ্যুতের তার চাপানো। যার ফলে ঘণ্টায় ২০-৩০ কিলোমিটার বেগের হাওয়া সহ্য করার ক্ষমতাও খুঁটিগুলির নেই। ভার লাঘব করতে গেলে জোটে স্থানীয় নেতা-দাদার নির্যাতন। মার খেয়ে এলাকাছাড়া হতে হয় পুরসভা বা সিইএসসি-র কর্মীদের।
তা হলে উপায়? কেন এখনও শহরে তারের জট সরে না? মেয়র ফিরহাদ হাকিম বললেন, ‘‘পাইলট প্রকল্পে কাজ চলছে। কেব্ল অপারেটদের বলা হয়েছে, সব জায়গা থেকে পুরনো তার সরিয়ে ফেলার জন্য।’’ তা-ই যদি হবে, তা হলে প্রতি ঝড়ের পরে একই ছবি দেখা যায় কেন? মেয়র পরিষদ দেবাশিস কুমারের কথায়, ‘‘মাটির নীচ দিয়ে তার নিয়ে যাওয়ার খরচ বিপুল। তাই একটু সময় লাগছে। তবে ভূগর্ভ দিয়ে তার নিয়ে যাওয়াই ভবিষ্যৎ।’’ কিন্তু গোটা বিষয়টা কি ভবিষ্যতের গর্ভেই রয়ে যাবে? সেই প্রশ্নের অবশ্য সদুত্তর মেলেনি।