Illegal Constructions

দেখেও না দেখাই নিয়ম, তাতেই পোয়াবারো অবৈধ নির্মাণের

শহর জুড়ে অবাধেই চলে অবৈধ নির্মাণ। পুলিশ বা পুরসভা সব জেনেও ব্যবস্থা নেয় না। কিন্তু কেন? উত্তরের খোঁজে আনন্দবাজার।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৫:২২
Share:

—প্রতীকী চিত্র।

‘আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি মাস্টারমশাই!’

Advertisement

শহর জুড়ে চলতে থাকা বেআইনি নির্মাণের ক্ষেত্রে পুরসভা, পুলিশ এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ভাবটা যেন অনেকটা এমনই। অভিযোগ, দেখেও না দেখার এই ‘পরম্পরা’ সমানে চলতে থাকায় শহর এবং সংলগ্ন এলাকার এক-একটি অংশ যেন হয়ে উঠছে ‘মিনি গার্ডেনরিচ’! নারকেলডাঙার এমনই একটি অংশে দীর্ঘদিনের অভিযোগ একটি বাড়ি ঘিরে। চার দিকে চারটি পুরনো স্তম্ভের উপরে পাঁচতলা ওই বাড়িটি তুলে ফেলা হয়েছিল। কিন্তু কয়েক বছরেই সেই বাড়ি আর নিজের ভার রাখতে পারছে না। হেলে গিয়েছে পাশের বাড়ির গায়ে। যার জেরে পাশের বাড়ির বারান্দার স্তম্ভ ভেঙে ভিতরের দিকে ঢুকে এসেছে। কী ভাবে ওই বাড়ি তৈরি হল? কেউই কি কিছু দেখেননি? উত্তর মেলে না।

একই অবস্থা যাদবপুরের আনন্দপল্লির কাছে একটি বহুতলের। অভিযোগ, সরু রাস্তার মধ্যে আশপাশে কোনও জায়গা না ছেড়েই বহুতলটি তোলা হয়েছে। স্থানীয়দের একাংশের দাবি, গত লোকসভা নির্বাচনের সময়ে ওই জায়গায় একটি রাজনৈতিক দলের ভোট-কার্যালয় গড়া হয়েছিল। তার পরে চার বছর কাটতে না কাটতেই সেখানে বহুতল উঠে গিয়েছে। স্থানীয় এক জনের অভিযোগ, ‘‘ভোটের মুখে এই জমি দখলে রাখতেই বহুতল তুলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু এই নির্মাণের না আছে কোনও ছাড়পত্র, না আছে এই জমিতে চারতলা পর্যন্ত ছাদ ঢালাই করার নিয়ম। নেতারা জড়িত বলে পুলিশ, পুরসভার ভূমিকা যেন, দেখেও কিছু দেখেনি।’’

Advertisement

অভিযোগ, শহর ও সংলগ্ন বহু জায়গায় চোখের সামনে এমন বেআইনি কাজ চললেও এ ভাবেই চোখ বুজে থাকে পুরসভা এবং পুলিশ। কোনও রকম অনুমতি না নিয়ে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে গেলেও পুরসভার কাউকে গিয়ে নোটিস ধরাতে দেখা যায় না। নির্মাণকাজের শেষে ফ্ল্যাট হস্তান্তর হয়ে গেলেও পুরসভা বা পুলিশ পদক্ষেপ করে না। বেআইনি অংশ ভাঙতে গিয়ে পুরকর্মীদেরই আবার কোনও কোনও ক্ষেত্রে পুরপ্রতিনিধির রোষের মুখে পড়তে হয় বলে অভিযোগ। অথচ, তার পরেও প্রশ্নের মুখে পড়ে পুলিশ বলে দেয়, ‘‘আমাদের কাছে কোনও অভিযোগ জমা পড়েনি।’’ পুরসভা জানায়, বিষয়টি দেখে নেওয়া হবে বা দ্রুত কাজ বন্ধের নোটিস ধরানো হবে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের প্রশ্ন, আগেই কেন পদক্ষেপ করা হয়নি? তাঁদের আরও দাবি, এর পরে সেই নির্মাণ ভেঙে পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলে তখন দিনকয়েক আলোচনা হয়। কখনও কখনও এই পরিস্থিতিকে ‘সামাজিক ব্যাধি’ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। তা নিয়ে নির্বাচনের মুখে রাজনীতিও হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের কোনও সুরাহা হয় না। এক ভুক্তভোগীর মন্তব্য, ‘‘খুব বেশি হলে প্রোমোটার, জমির মালিক আর রাজমিস্ত্রিকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু চোখ বুজে থাকার শাস্তি হয় না পুরসভা বা পুলিশের কারওই।’’

বিধাননগর পুর এলাকার আই বি ব্লকের একটি কোঅপারেটিভ আবাসনের বাসিন্দাদের আবার অভিযোগ, পুরসভা বা পুলিশকে জানিয়েও নির্মাণের বেআইনি ব্যবহারের ক্ষেত্রে সুরাহা পাননি তাঁরা। বিধাননগরে কোঅপারেটিভ ভবনের কোনও অংশ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের নিয়ম নেই। কিন্তু সেই নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই তাঁদের কোঅপারেটিভ ভবনের একতলায় খাবারের দোকান করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে তাঁরা পুলিশে গিয়েছিলেন। অভিযোগ জানানো হয়েছিল পুরসভাতেও। কিন্তু সুরাহা তো মেলেইনি, বিষয়টিকে আদৌ গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি বলে অভিযোগ। উল্টে সেখানকার আবাসিকদের দাবি, ওই দোকানেই এক জনপ্রতিনিধিকে নিয়মিত আসর জমাতে দেখা যায়। তিনি বিধাননগর পুর কর্তৃপক্ষের ঘনিষ্ঠ বলে এলাকায় পরিচিত! ফলে তাঁদের প্রশ্ন, ওই জনপ্রতিনিধির প্রভাবেই কি অনিয়ম দেখেও ‘চোখ বুজে’ থাকে বিধাননগর পুরসভা?

বাগুইআটির দেশবন্ধুনগর এলাকায় আবার পাঁচ মিটার রাস্তার উপরেই মাথা তুলে রয়েছে সাততলা নির্মাণ। দমদমের বিভিন্ন এলাকাতেও একই পরিস্থিতি। সেখানেও ছ’-সাত ফুট চওড়া রাস্তায় অবলীলায় ছ’-সাততলা বাড়ি উঠে গিয়েছে। কিন্তু পুরসভা জানে না? সেগুলির কোনও-কোনওটি ভেঙে মৃত্যুর ঘটনা ঘটার পরে বিরোধীদের একাংশের প্রশ্ন, বঙ্গীয় পুর আইন অনুসারে, বাড়ির সামনের রাস্তার মাপ অনুযায়ী বাড়ির তলের সংখ্যা নির্ধারিত হওয়ার কথা। সেই নিরিখে সরু রাস্তায় বহুতল ওঠার কথাই নয়। প্রকাশ্যে না বললেও ঘনিষ্ঠ মহলে প্রশাসনিক কর্তাদের দাবি, নির্মাণকাজে অনুমতি পেতে অনেকেই নিকটবর্তী বড় রাস্তাটিকে বাড়ির সামনের রাস্তা হিসাবে দেখান। কিন্তু পুরকর্মীদের দল পরিদর্শন করলেই তো সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ধরা পড়ে যায়। তবে কি কোনও ক্ষেত্রেই পরিদর্শন হয় না?

কলকাতার মেয়র তথা রাজ্যের পুরমন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম এ প্রসঙ্গে শুধু বলেন, ‘‘সমস্ত দিক থেকেই এখন কড়া পদক্ষেপ করা হচ্ছে। আইন সংশোধনেরও ভাবনা চলছে।’’ কিন্তু এই ভাবনা কেন আগে ভাবা হয়নি? স্পষ্ট উত্তর মেলে না। (চলবে)

তথ্য সংগ্রহ: প্রবাল গঙ্গোপাধ্যায়, নীলোৎপল বিশ্বাস, কাজল গুপ্ত, চন্দন বিশ্বাস, মেহবুব কাদের চৌধুরী

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement