—প্রতীকী চিত্র।
হেনস্থা ধেয়ে আসে নানা ভাবে এবং নানা দিক থেকে। কখনও তা মানসিক, কখনও বা শারীরিক। কখনও সেই হেনস্থার জায়গা ক্লাসরুম বা খেলার মাঠ, কখনও বা অন্য কোনও জনপরিসর। যে কারণে মাঝেমধ্যেই প্রশ্ন ওঠে, এ শহরের কোথাও কি নিজেদের পুরোপুরি ‘নিরাপদ’ বলে ভাবতে পারেন অটিস্টিক মানুষেরা? রবিবারের সন্ধ্যার একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে যে প্রশ্ন আরও জোরালো হয়ে উঠেছে। ওই ঘটনায় এক অটিস্টিক যুবককে শারীরিক ভাবে নিগ্রহ করা হয়েছে বলে অভিযোগ। অভিযুক্ত তিন জনই নাবালক। তাদের মধ্যে এক জন ওই যুবককে আগেও উত্ত্যক্ত করেছে বলে অভিযোগ। পুলিশ তিন নাবালককে থানায় ডেকে পাঠিয়ে তাদের এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলছে।
পুলিশ জানায়, রবিবার সন্ধ্যায় চেতলার বাড়ি থেকে বেরিয়ে সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের দিকে যাচ্ছিলেন বছর বাইশের ওই যুবক। অভিযোগ, রাসবিহারী মোড়ের কাছে তাঁর পথ আটকায় তিন নাবালক। তারা প্রথমে ওই যুবককে রাস্তায় নাচতে বলে। কিন্তু তিনি রাজি না হওয়ায় তাঁকে মারধর করা হয়। রাতে বাড়ি ফিরে গোটা ঘটনার কথা পরিবারকে জানান নিগৃহীত যুবক। তাঁর পরিজনেরা সঙ্গে সঙ্গে টালিগঞ্জ থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। পুলিশ তদন্ত শুরু করে। ঘটনাস্থলের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করার পাশাপাশি আক্রান্ত যুবকের সঙ্গেও কথা বলেন তদন্তকারীরা। ঘটনার পর থেকে ওই যুবক প্রবল আতঙ্কে আছেন বলে জানিয়েছেন তাঁর মা। মহিলার প্রশ্ন, বাড়ির কাছে এবং রাসবিহারী মোড়ের মতো এক জনবহুল এলাকায় এক জন অটিস্টিকের সঙ্গে যদি এই ঘটনা ঘটতে পারে, তা হলে ওই যুবকের মতো মানুষেরা রাস্তাঘাটে নিজেদের নিরাপদ বোধ করবেন কী করে?
অটিজ়ম নিয়ে কাজ করা একাধিক সংগঠনের সদস্যদের মতে, এই নিগ্রহ শুধু ওই যুবকের নয়, এ শহরের প্রত্যেক অটিস্টিক মানুষের উপরেই একটা আঘাত। তাঁরা জানাচ্ছেন, অটিজ়ম থাকলে সাধারণত আত্মবিশ্বাস গড়ে উঠতেই অনেকটা সময় লেগে যায়। সেই গড়ে তোলারও বিভিন্ন প্রক্রিয়া ও পর্যায় রয়েছে। অটিস্টিক মানুষেরা কষ্টার্জিত সেই আত্মবিশ্বাসে ভর করেই বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে সমাজের মূল স্রোতে আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু মূল স্রোতে মেশার লক্ষ্যে আর পাঁচ জনের মতো রাস্তায় বেরোলেই যদি তাঁদের হেনস্থার শিকার হতে হয়, সে ক্ষেত্রে তাঁরা স্বাভাবিক জীবনযাপন করবেন কী করে? সারা ক্ষণই ভয়ে ভয়ে থাকবেন।
‘অটিজ়ম সোসাইটি, ওয়েস্ট বেঙ্গল’-এর ডিরেক্টর ইন্দ্রাণী বসু বললেন, ‘‘অটিস্টিক মানুষেরা জানেন, তাঁদের অনেক সমস্যা আছে। তা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেন তাঁরা। নিজেদের কাজ নিজেরাই করে নিতে চান। কিন্তু এই ধরনের হেনস্থার ঘটনা তাঁদের মানসিক ভাবে অনেকটা পিছনে ঠেলে দেয়। সেখান থেকে বেরিয়ে আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতেই অনেক সময় লেগে যায়। শুধু আক্রান্ত যুবক নন, অন্যদের উপরেও এই ঘটনা প্রভাব ফেলবে।’’ তবে, ব্যস্ত রাস্তায় ওই যুবককে আক্রান্ত হতে দেখেও কেন কেউ এগিয়ে এলেন না, তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তিনি। একই প্রশ্ন তুলেছেন অটিস্টিকদের নিয়ে কাজ করা একটি সংস্থার ডিরেক্টর শম্পা সেনগুপ্তও। তিনি বলেন, ‘‘এই গোটা ঘটনাটি ওই যুবকের আত্মবিশ্বাসে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। ভিন্নতাকে মেনে না নেওয়ার প্রবণতাই গোটা ঘটনার জন্য দায়ী।’’
সেরিব্রাল পলসিতে আক্রান্ত সমাজকর্মী জিজা ঘোষ একাধিক বার বিভিন্ন জায়গায় হেনস্থার শিকার হয়েছেন। প্রতিবাদে সরবও হয়েছেন। এই ঘটনার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘‘২০-২৫ বছর আগে যা ঘটত, তা এখনও ঘটবে কেন? কোথায় দাঁড়িয়ে আছি আমরা? কোথায় যাচ্ছি? ব্যস্ত রাস্তায় এক জনকে কয়েক জন মিলে মারছে, আর সকলে দাঁড়িয়ে দেখছেন! কেউ প্রতিবাদ করেননি! এই ঘটনা মানা যায় না। এটা একটা সামাজিক অবক্ষয় এবং অবশ্যই সচেতনতার অভাব।’’