শিকড়ের টান আলগা করে নাগরিক জীবনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠাই বিশ্বায়নের স্বাভাবিকতা। তবু শরৎ এলেই কংক্রিট জঙ্গলের ফাঁকে ইতিউতি নির্মেঘ নীল আকাশ দেখে মন আনচান, পুরনো সেই সব দিনের কথা ভেবে। সারা বছরের রুটিনের বাইরে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠে, অষ্টমীর অঞ্জলিতে, পাড়ার আড্ডায়, দশমীর সিঁদুর খেলায় সাবেকিয়ানার উদ্যাপনই এখন পুজোর আকর্ষণ। বাঙালির প্রাণের পুজোর এই সাবেক মেজাজের সঙ্গে তাল মিলিয়েই বড়িশা সর্বজনীনের পুজো-ভাবনা ‘রঙিন হল হোগলা পাতা, আসছে ফিরে অতীত গাথা’। এক কালে বৃহত্তর সুন্দরবনের অংশ বড়িশার মণ্ডপ সাজবে সেই সুন্দরবনেরই প্রতীক হোগলা পাতা দিয়ে। নগরায়ণের অন্যতম সমস্যা পরিবেশ দূষণ, তাই অতীতচারণার সঙ্গে বাস্তব সমস্যার কথা মনে রেখেই পরিবেশবান্ধব হোগলার ব্যবহার মণ্ডপ ও প্রতিমাসজ্জায়।
মাটির সঙ্গে মানুষের আত্মিক যোগ মনে পড়িয়ে দিতে এ বার হাটখোলা গোঁসাইপাড়া সর্বজনীনের থিম ‘বোধনের আঙিনায় মাটিতে প্রাণ, বাংলার পুতুলে শিল্পের দান’। দক্ষিণ ২৪ পরগনার লুপ্তপ্রায় গ্রামীণ শিল্পকলা ‘টেপা পুতুল’ দিয়ে সেজে উঠবে হাটখোলার মণ্ডপ। বিস্মৃত এই শিল্পকে জনসমক্ষে তুলে ধরতে টেপা পুতুলের আদলে তৈরি হচ্ছে প্রতিমাও।
মাটির পুতুলের মাধ্যমে আঞ্চলিক সমাজজীবন ও সংস্কৃতির প্রকাশ ঘটবে বসাকবাগান সর্বজনীনের দুর্গোৎসবেও। মেদিনীপুরের দেওয়ালি পুতুলের রোশনাইয়ে প্রাণ পাবে ৫০তম বর্ষের থিম ‘রংবাজি’। সারা বছরের দিন যাপনে অন্য মাত্রা যোগ করে শারদোৎসব। সেই উৎসব আরও রঙিন করতে হাতির আকারে তৈরি মণ্ডপ সাজাবে অজস্র আলো এবং বারুদবিহীন বাজি। মণ্ডপের সামনে রাবণ মূর্তির গায়ে আঁকা রামায়ণের আখ্যান সে পরিবেশে আনবে মহাকাব্যিক ছোঁয়াও।
আধুনিকতার যুগে পুজো ছাড়িয়েছে দেশ ও কালের গণ্ডী। তাই প্রাচীন তালপাতা, হোগলা পাতার ছাতা থেকে শুরু করে আধুনিক যুগের ছাতা এবং ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রদেশের ছাতা ব্যবহৃত হচ্ছে মানসবাগ স্পোর্টিং ক্লাবের পুজো মণ্ডপে। মণ্ডপসজ্জার এই ভাবনার মধ্যে নিহিত আছে সংহতির বার্তা। সাম্প্রদায়িকতায় জর্জরিত ভারতবর্ষে একই ছাতার তলায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একত্রিত হওয়ার ডাক দিয়ে বিবিধের মাঝে মহান মিলনকেই কুর্নিশ করছে মানসবাগ স্পোর্টিং-এর মণ্ডপ।
ভৌগোলিক বাধা পেরিয়ে পুজোর শহরে হাজির ওড়িশার ঐতিহ্যবাহী পিপলি শিল্পও। এ বার পুজোয় রাসবিহারী সুহৃদ সঙ্ঘের থিম ‘শ্রীক্ষেত্রে উমা’। পুরী জেলার পিপলি শিল্পের রঙিন কারুকার্যে ঝলমলিয়ে উঠবে মণ্ডপ। পুরীর মন্দিরের সিংহের আদলে তৈরি হচ্ছে মায়ের বাহন। বাঙালির ঘরের মেয়ে উমার আরাধনা এখানে বাঙালির প্রিয় তীর্থের প্রেক্ষাপটে।
মা আসছেন। উৎসবের প্রস্তুতি তাই শহর জুড়ে। এর মধ্যেই অন্য রকম সাজে দেবীবন্দনার প্রস্তুতি নিচ্ছে সম্মিলিত লালাবাগান সর্বজনীন। খেটে খাওয়া এক রাজমিস্ত্রির চোখে পুজোর রূপ কেমন, তা ফুটিয়ে তোলা হবে মণ্ডপে। উৎসবের আনন্দ থেকে যাঁরা প্রায়শই থাকেন বঞ্চিত, সেই সব শহর গড়ার কারিগরদের নিত্য ব্যবহার্য হাতুড়ি, কড়াই, কোদাল, বেলচা দিয়ে সাজানো মণ্ডপে ধরা পড়বে প্রান্তিক মানুষদের পুজোভাবনা ‘ভাঙা গড়ায় জীবন ভরা, মায়ের পুজোয় শরিক মোরা’। গড়া হয়েছে এই ভাবনার সঙ্গে মানানসই বালির প্রতিমাও। আনন্দযজ্ঞে সকলকে সামিল করতে পারাই যে সর্বজনীন পুজোর সাফল্য।