মৃত ছাত্রের দেহ নিয়েই থানার সামনে বিক্ষোভ। মঙ্গলবার, কসবায়। ছবি: সুমন বল্লভ।
স্কুলে উপর থেকে নীচে পড়ে গেলেও কেন কোনও আঘাতের চিহ্ন নেই শরীরে— কসবায় ছাত্রের রহস্য-মৃত্যুতে সেই প্রশ্ন তুলছে তার পরিবার। এমনকি, ঘটনার পরে স্কুল কর্তৃপক্ষের বার বার বয়ান বদল নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন তাঁরা। পরিবারের অভিযোগ, মানসিক চাপ দিয়ে পরিকল্পনা করেই খুন করা হয়েছে দশম শ্রেণির ছাত্র শেখ শানকে (১৬)। যদিও মঙ্গলবার ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে ছাত্রের চোয়াল ও শরীরের ডান দিকের একাধিক হাড় ভেঙেছে বলে জানা গিয়েছে। গোটা ঘটনার তদন্ত চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।
এ দিন এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পড়ুয়ার দেহের ময়না তদন্ত করা হয়। তার জন্য তিন সদস্যের মেডিক্যাল বোর্ড গঠন করা হয়। তা ভিডিয়োগ্রাফিও করা হয়েছে। সন্ধ্যায় ময়না তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে জানা যায় যে শানের চোয়াল এবং শরীরের ডান দিকের একাধিক হাড় ভেঙেছে। এর পরেই অভিযুক্তদের গ্রেফতারির দাবিতে মৃত ছাত্রের দেহ নিয়ে কসবা থানার সামনে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন পরিজন ও প্রতিবেশীরা। রাত ৯টা থেকে ওই বিক্ষোভ শুরু হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ছাত্রের বাবাও। বিজন সেতু থেকে রুবিগামী রাস্তা বন্ধ করে দেয় পুলিশ। ফলে রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভোগান্তির মুখে পড়েন যাত্রীরা। সাউথ সাবার্বান ডিভিশনের ডেপুটি কমিশনার বিদিশা কলিতা দাশগুপ্ত ও যাদবপুর থানার ওসি রাতে থানায় আসেন। পরিস্থিতি সামলাতে আসে বিশাল বাহিনীও। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-মৃত্যুর মতো এই ঘটনাও সমান গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত হবে, এই আশ্বাস পেয়ে রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ বিক্ষোভ ওঠে।
সোমবার কসবার রথতলায় একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নীচ থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় শানকে উদ্ধার করা হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে উপর থেকে পড়ে গিয়েই ওই ছাত্রের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা যায়। রাতেই পড়ুয়ার পরিবারের তরফে স্কুলের প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপাল এবং দুই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে কসবা থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়। ঘটনার তদন্তে মঙ্গলবার ঘটনাস্থলে আসে কলকাতা পুলিশের ফরেন্সিক দল। তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করার পাশাপাশি ছ’তলাতেও যায়। সেখানে যে অংশ থেকে শানকে শেষ দেখা গিয়েছিল, সেটি ঘুরে দেখেন ফরেন্সিক আধিকারিকেরা। লোহার গ্রিল ঘেরা ওই জায়গার একটি বড় ফাঁকা অংশ দিয়ে মাথা ঢুকিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে পরীক্ষা করেন তাঁরা। শানের ওজনের সমান একটি পুতুল সেখান দিয়ে নীচে ফেলা হয়।
তদন্তে পুলিশ জেনেছে, স্কুলের নির্মীয়মাণ ছ’তলার একাংশে শিক্ষকেরা বসতেন। পাঁচতলায় ছিল শানের ক্লাস। পুলিশ জানিয়েছে, এফআইআর রুজু করার আগে সেই রাতে সাড়ে ১০টা নাগাদ স্কুলের প্রিন্সিপাল ইমেল করেন কসবা থানার ওসি-কে। তাতে তিনি ছাত্রের মৃত্যুর এই ঘটনাকে দুর্ভাগ্যজনক বলে উল্লেখ করে জানান, সোমবার স্কুলে অঙ্কের প্রজেক্টের খাতা জমা দেওয়ার কথা ছিল শানের। কিন্তু সে তা না করায় অঙ্কের শিক্ষিকা তাকে বকাবকি করেন এবং তার বাবাকে এ কথা জানানো হবে বলে জানান। ইমেলে প্রিন্সিপালের দাবি, সে কথা শুনে শান ওই শিক্ষিকার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেছিল। পুলিশ জানিয়েছে, এর পরেই তিনি শানকে ছ’তলায় ক্লাস টিচারের কাছে নিয়ে যান। সেখানে তাকে স্টাফরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বলা হয়। তবে মিনিট দুয়েক পরেই তাকে ক্লাসে চলে যেতে বলা হয়েছিল। কিন্তু এর পরে সে ক্লাসে না গিয়ে নির্মীয়মাণ অংশে যায় এবং সেখান থেকে ঝাঁপ দেয় বলে মনে করছে পুলিশ। ছ’তলার সিসি ক্যামেরায় ফুটেজে স্টাফরুমের বাইরে শানকে ঘোরাঘুরি করতে দেখা গিয়েছে বলে পুলিশ সূত্রের খবর। প্রিন্সিপালও পুলিশকে জানিয়েছেন, শান ক্লাসে না গিয়ে সেখান থেকে ঝাঁপ দিয়েছে বলেই তাঁদের ধারণা। তার পরে শানের চিকিৎসা করানোর চেষ্টা করা হলেও বাঁচানো যায়নি তাকে।
তদন্তে পুলিশ জেনেছে, ওই ছাত্রের মা-বাবা একসঙ্গে থাকেন না। বাবার কাছে থাকত শান। তবে স্কুলে সব সময়েই সে চুপচাপ থাকত। লালবাজার জানিয়েছে, মৃত ছাত্রের বাবার অভিযোগের ভিত্তিতে খুনের মামলা দায়ের হয়েছে স্কুলের প্রিন্সিপাল, ভাইস প্রিন্সিপাল এবং দুই শিক্ষিকার বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় পুলিশ স্কুলের কর্মীদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করবে। ঘটনার আগে কোনও এক বন্ধুর জন্মদিনের পার্টিতে গিয়েছিল শান। সেখানেও কিছু হয়েছিল কি না, তার খোঁজ করছে পুলিশ।
এ দিন সকালে স্কুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলে কসবার রথতলা সংলগ্ন বি বি চ্যাটার্জি রোড ঘণ্টাখানেক অবরোধ করেন এলাকার বাসিন্দারা। সেখানে ছিলেন মৃত পড়ুয়ার মা পিঙ্কি বিবিও। পরে কসবা থানার পুলিশ এসে বুঝিয়ে অবরোধ তুলে দেয়। পিঙ্কি বলেন, ‘‘স্কুলে পড়াশোনার বদলে ব্যবসা হয়। আমরা করোনার পরে স্কুলের ফি বৃদ্ধির প্রতিবাদ করেছিলাম বলে ছেলেকে পরিকল্পনা করে খুন করা হয়েছে। দোষীদের ফাঁসি চাই।’’ প্রতিবেশী জোৎস্না মণ্ডলের দাবি, ‘‘দুপুর ২টো ১৫ মিনিট নাগাদ আমাদের ফোন করা হয়েছিল। আমি শানের বাবার সঙ্গে হাসপাতালে গিয়েছিলাম। শানের দেহে কোনও আঘাতের চিহ্ন ছিল না। এমনকি, কোনও হাড়ও ভাঙা ছিল না। এত উঁচু থেকে পড়েও হাড় ভাঙল না!’’ শানের বাবা শেখ পাপ্পু বলেন, ‘‘স্কুল থেকে প্রথমে বলা হয়েছিল, মাথা ঘুরে উঁচু থেকে পড়ে গিয়েছে। পরে বলা হয়, সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়েছে। কিন্তু সিঁড়ি বা ছাদ থেকেই যদি পড়ে যাবে, তা হলে আঘাতের চিহ্ন নেই কেন?’’
এ দিন সকালে শানের বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে কসবা থানার পুলিশ। এক তদন্তকারী আধিকারিক বলেন, ‘‘সব দিক খোলা রেখেই তদন্ত করা হচ্ছে। স্কুল কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও কথা বলা হবে। প্রয়োজনে ওই পড়ুয়ার সহপাঠীদের সঙ্গেও কথা বলা হবে।’’