—ফাইল চিত্র।
ব্যাঙ্কের পাসবই হারিয়ে গিয়েছে। দুপুর রোদে গ্রামের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন মহিলা। জিজ্ঞাসা করছেন, ‘‘দাদা, বলে দিতে পারেন, এই অভিযোগ কোন থানা নেবে? নতুন সব থানা হওয়ার পর থেকে তো বোঝাই যাচ্ছে না!’’
এক যুবকের পরামর্শে মহিলা পৌঁছলেন ভাঙড়ের উত্তর কাশীপুর থানায়। যদিও তাঁর ঘটনা ভাঙড়ের বিজয়গঞ্জ বাজার থানায় নথিভুক্ত হওয়ার কথা। কিন্তু এ বার আর ফিরিয়ে দেওয়া হল না মহিলাকে। থানার দরজায় কর্তব্যরতপুলিশকর্মী বললেন, ‘‘ভিতরে যান। বিজয়গঞ্জ ভবন এখনও তৈরি হয়নি। তাই ওই থানার সব কেস এখানেই লেখা হচ্ছে।’’ দৃশ্যত আশ্বস্তমহিলার চিন্তা, পরে কি আবার অন্য কোথাও মামলা চলে যাবে? পুলিশকর্মীর উত্তর, ‘‘বিজয়গঞ্জবাজার থানার ভবন তৈরি হলে এখান থেকে ওই থানার সব মামলা সেখানে পাঠিয়ে দেওয়া হবে!’’ মহিলার প্রশ্ন, ‘‘তা হলে তো আবার বিজয়গঞ্জ বাজার থানা কোথায় তৈরি হল, সেটা খুঁজতে হবে!’’
গত জানুয়ারির ৮ তারিখ ভাঙড় কলকাতা পুলিশের অন্তর্গত হওয়ার পর থেকে সেখানকার একাধিক থানায় কাজ চলছে এ ভাবেই। সূত্রের খবর, সেখানকার মাধবপুর,বোদরা, হাতিশালা ও বিজয়গঞ্জ বাজার থানা চালু হয়েছে শুধু খাতায়-কলমেই। সেগুলির ভবন এখনও তৈরিহয়নি। ভাঙড় থানা ভেঙে তৈরি হওয়া ভাঙড় ও চন্দনেশ্বর থানা এবংকাশীপুর থানা ভেঙে তৈরি হওয়া পোলেরহাট ও উত্তর কাশীপুর থানায় গিয়ে অভিযোগ লেখাতে হচ্ছে এলাকার বাসিন্দাদের।
এই পরিস্থিতিতেই কলকাতা পুলিশে যুক্ত হওয়ার পাঁচ মাসের মধ্যে ভাঙড়ের লোকসভা নির্বাচন সামাল দিতে চলেছে লালবাজার। প্রশ্ন উঠেছে, এই পরিকাঠামো নিয়ে গ্রাম্য জনজীবনের একটি বিস্তীর্ণ এলাকাকে কি যথাযথ ভাবে সামলানো যাবে?
জানা যাচ্ছে, কলকাতা পুলিশের অধীনে থাকা ভাঙড়ের কিছু এলাকা জয়নগর এবং কিছু এলাকা যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। জয়নগর লোকসভা কেন্দ্রে বুথ এবং ভোট গ্রহণ কেন্দ্রের সংখ্যা যথাক্রমে ১২৪ ও ৮০। যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে তা ২৮৪ এবং ১৬৬টি। এ দিকে, কলকাতা পুলিশ এলাকাযেখানে ৩১১ বর্গকিলোমিটারের আশপাশে, সেখানে ভাঙড়ের দু’টি ব্লক মিলিয়েই আয়তন প্রায় ২৭৩ বর্গকিলোমিটার। এই বিশাল জায়গা সামাল দিতে আটটি থানা তৈরির সিদ্ধান্ত হলেও এখনও বেশি সংখ্যক পুলিশকর্মী মোতায়েন করতে হলে নির্ভর করতে হচ্ছে সেই লালবাজারের উপরেই। জানা যাচ্ছে, আইনশৃঙ্খলার সমস্যা তৈরি হলে এখনও সেই ৩০ কিলোমিটার দূরের লালবাজার বা কলকাতা থেকেই ভাঙড়ে বাহিনী পাঠাতে হয়। পাশাপাশি, পুলিশকর্মীদের চিন্তা বাড়িয়েছে ভাঙড়ের গ্রাম্য চরিত্র।
কলকাতার সমস্ত রাস্তা এবং গলিপথের চরিত্র কলকাতা পুলিশের নখদর্পণে থাকলেও ভাঙড়ের ক্ষেত্রে তা নেই। গ্রামের বেশির ভাগ পথঘাট এখনও চেনা হয়নি সেখানকার দায়িত্ব নিয়ে যাওয়া কলকাতা পুলিশের কর্মীদের। চিন্তা বাড়িয়েছে ভাঙড়ের ধান খেত, পাট খেত। ওই সমস্ত জায়গা থেকে গত কয়েক দিনে শয়ে শয়ে বোমা উদ্ধার হলেও ভোটের দিন খেত পাহারা দেওয়া আদৌ কলকাতা পুলিশের পক্ষে সম্ভব কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
লালবাজারের কর্তারা যদিও দাবি করছেন, বাড়তি পুলিশ মোতায়েন করার পাশাপাশি এই ভোটে থাকবে কেন্দ্রীয় বাহিনী। গ্রামে ঢুকে নজরদারি চালানোর জন্য আলাদা করে রাখা হচ্ছে মোটরবাইক বাহিনী।পাশাপাশি, সমস্ত রাজনৈতিক দলের অন্তত দশ জন বড় নেতাকে আতশকাচের তলায় রাখা হয়েছে। বুথ-ভিত্তিক গোলমাল পাকাতে পারেন, এমন লোকেদের নামের তালিকা তৈরি করে তাঁদেরও দফায় দফায় সতর্ক করা হচ্ছে। এমন পুরনো অভিযুক্তদের গ্রেফতারও করা হতে পারে। ভাঙড় ডিভিশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত এক পুলিশ আধিকারিক বললেন, ‘‘বিভিন্ন মামলায় নাম থাকা এবং খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত আরাবুল ইসলাম এখনও হাজতে থাকায় সমস্ত স্তরে একটা বার্তা গিয়েছে। ফলে ভোট এ বার অনেকটাই শান্তিপূর্ণ হবে।’’
কিন্তু ভাঙড়ে কান পাতলেই শোনা যাচ্ছে, বাইরে থেকে ভোট করাতে আসা নেতাদের ‘স্নেহধন্য’ বাহিনী এ বারও ভোট করাতে ময়দানে ঢুকলে গত কয়েক দিনে ভাঙড়ে চালানো পুলিশের ‘ম্যান মার্কিং’ কাজে লাগবে তো? প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। দিনকয়েক আগে এক নেতা আবার প্রকাশ্যেই বলেছেন, ‘‘শুধু পঞ্চায়েত ভোটেই সাত জন মারা গিয়েছিলেন। এ বার যদি ১০টা লাশও পড়ে, আমরা পিছপা হব না।’’