রুদ্ধ-পথ: ফুটপাথের উপরেই কড়াই রেখে বাজা হচ্ছে জিলিপি, কচুরি। রবিবার, অরবিন্দ সরণীতে। ছবি: স্বাতী চক্রবর্তী।
কোথাও ফুটপাত আটকে বিশাল কড়াই পেতে ফুটন্ত তেলে সিঙাড়া, চপ ভাজা চলছে। কোথাও রাস্তাতেই বড় পাত্রে গরম রস বানিয়ে চলছে জিলিপি বা অমৃতি তৈরি। কোথাও রাস্তা এবং ফুটপাতের অনেকটা দখল করেই ফুটছে চা। চাউমিন, রোল বা অন্য ভাজাভুজির দোকানেরও অন্ত নেই! পথচারীরা হয় ভয়ে ভয়ে পাশ দিয়ে কোনও মতে হাঁটাচলা করছেন, নয়তো গরম কড়াই এড়াতে নির্দ্বিধায় নেমে যাচ্ছেন গাড়ি চলার রাস্তায়।
শুক্রবার বিকেলে অজয়নগরে এমনই একটি দোকানে মৃত্যু হয় ওই এলাকারই একটি বৃদ্ধাশ্রমের এক আবাসিকের। গরম কড়াই উল্টে যায় তাঁর উপরে। ফুটন্ত তেলে ঝলসে যায় শরীর। হাসপাতালে নিয়ে গেলে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। দোকানমালিকের দাবি, ওই বৃদ্ধ হঠাৎ অসুস্থ বোধ করেন। মাটিতে পড়ে যাওয়ার সময়ে তিনি কড়াই ধরে টাল সামলানোর চেষ্টা করতেই ঘটে বিপত্তি। পুলিশ সেই বক্তব্যের সত্যতা যাচাই করে দেখছে। তবে অনেকেরই প্রশ্ন, ফুটপাত আটকে কড়াই পেতে ব্যবসা চলবে কেন? সামনে গরম তেলের কড়াই না থাকলে কি এতটা বিপজ্জনক হত ব্যাপারটা? ভুক্তভোগীদের বড় অংশই বলছেন, গোটা শহর জুড়েই যাতায়াতের রাস্তা বা ফুটপাত দখল করে খাবারের ব্যবসা চলে। কখনও কারও শাড়িতে আগুন ধরে যাওয়ার খবর সামনে আসে, কখনও ফুটপাত দিয়ে যাওয়া শিশুর আহত হওয়ার ঘটনা থানায় অভিযোগ আকারে জমা পড়ে। কিন্তু পরিস্থিতি বদলায় না।
হকার সংগ্রাম কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক দেবাশিস দাস নিজেই বললেন, ‘‘এমন দোকানের বিরুদ্ধে আমি একাধিক অভিযোগ জমা দিয়েছি। এঁরা কিন্তু হকার নন। দোকান ভাড়ায় নিয়ে ফুটপাত বা রাস্তা দখল করে ব্যবসা করেন।’’ দেবাশিসের অভিযোগ, কলকাতা পুরভবনের কাছেই একটি নামী বিরিয়ানির দোকানের পাশে এমন জিনিস চলছে বহু বছর। গণেশ অ্যাভিনিউয়ের আর একটি দোকানের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘অফিসপাড়ায় এই উপদ্রব সবচেয়ে বেশি। হকার সমীক্ষা করতে গিয়েও আমরা দেখেছি, এমন দোকান নিয়েই ঝক্কি পোহাতে হচ্ছে। গত কয়েক বছরে এমন দোকান বেড়েছে প্রায় ৭০ শতাংশ।’’
আইনজীবীরাও জানাচ্ছেন, এ ভাবে ব্যবসা পুরোটাই বেআইনি। তাঁদের মতে, ২০১৪ সালের পথ বিক্রেতা (জীবিকা সুরক্ষা ও পথ ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ) আইনকে হাতিয়ার করে এর পক্ষে কথা বলা হয়। কিন্তু হকারি এবং এই ভাবে ব্যবসা কখনওই এক নয়। এ ক্ষেত্রে রীতিমতো কলকাতা পুরসভা থেকে লাইসেন্স নিতে হয়। আইনজীবী অরূপ নিয়োগী বলেন, ‘‘১৯৮০ সালের কলকাতা মিউনিসিপ্যাল আইন অনুযায়ী, ট্রেড লাইসেন্স পেতে যে ফর্ম পূরণ করতে হয়, তাতে দোকানের নাম, ঠিকানারপাশাপাশি জানাতে হয় দোকানটি কতটা জায়গার উপরে রয়েছে। সেটি ভাড়ায় নেওয়া, না কি নিজস্ব, সেই তথ্যও দিতে হয়। দোকানঘর কেনা যায় বা ভাড়ায় নেওয়া যায়। কিন্তু কোনও রাস্তা কেনা বা ভাড়া নেওয়া যায় না।’’
তা হলে বছরের পর বছর এমন দোকান চলে কী করে? আইনজীবীদের অভিযোগ, এর সঙ্গে স্থানীয় রাজনীতির যোগ থাকে। এই প্রসঙ্গেই তাঁরা বলছেন শ্যামবাজারের একটি ঘটনার কথা। সেখানে ফুটপাতের দোকান কিনেছেন দাবি করে সরাসরি মেয়রকে ফোন করেছিলেন এক মহিলা। তার পরেই সামনে আসে রাস্তা বা ফুটপাত মোটা টাকায় হকারদের বিক্রি বা ভাড়া দেওয়ার চক্রের বিষয়টি। তড়িঘড়ি হকার সমীক্ষার তোড়জোড়ও হয়। কিন্তু সমীক্ষা মিটে গেলেও এখনও কোনও হকারই পাননি শংসাপত্র। বন্ধ হয়নি রাস্তা এবং ফুটপাত জুড়ে বেআইনি ব্যবসা।
কলকাতা পুলিশের কোনও কর্তাই অবশ্য এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তাঁরা শুধু জানিয়েছেন, বিষয়টি পুরসভার দেখার কথা। দরকারে তাঁরা সাহায্য করবেন। কলকাতাপুরসভার মেয়র পারিষদ (হকার পুনর্বাসন) দেবাশিস কুমার যদিও বললেন, ‘‘ট্রেড লাইসেন্স থাকা সত্ত্বেও রাস্তা বা ফুটপাতে যাঁরা গ্যাস আভেন বা অন্য কোনও ভাবে আগুনজ্বালিয়ে ব্যবসা করছেন, তাঁরা শুধু অন্যায় নয়, অপরাধ করছেন। পুরসভা থেকে কড়া পদক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।’’