ধূম্রজাল: শোভাবাজারে রাস্তার পাশে রাখা কয়লার উনুন থেকে ছড়াচ্ছে দূষণ। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
রান্না করতে যে জ্বালানি ব্যবহৃত হয়, তা থেকে ছড়ানো দূষণের কারণে প্রতি বছর সারা বিশ্বে মারা যান প্রায় ৪৩ লক্ষ মানুষ। এমনই জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সেই মানচিত্র থেকে বাদ নেই কলকাতাও। এখানে দূষণের আঁতুড়ঘর খাবারের ঝুপড়িগুলি! এই পর্যবেক্ষণ উঠে এসেছে ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ ইনস্টিটিউট (নিরি)-এর গবেষণায়।
বাতাসে ভাসমান ধূলিকণার নিরিখে শহরের বায়ুদূষণে ঝুপড়িগুলির ‘অবদান’ কী, তা ইতিমধ্যেই নিজেদের প্রাথমিক রিপোর্টে উল্লেখ করেছে নিরি। এর পাশাপাশি শহরের রাস্তার দু’ধারে খাওয়ার ঝুপড়িগুলিতে, যেখানে মূলত কয়লার উনুনে রান্না হয়, সেখানে পৃথক একটি গবেষণা করেছিল তারা। তাতে যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে কাল বুধবার ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’-এ উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ থাকছে।
কারণ গবেষণায় ধরা পড়েছে, ঝুপড়িগুলিতে ধারাবাহিক ভাবে কয়লার উনুনে রান্না শুধু যে শহরের বাতাসে কার্বন মনোক্সাইডের মাত্রা বাড়িয়ে দেয় তা-ই নয়, সেই
ঝুপড়িতে বসে থাকা ক্রেতা-বিক্রেতাদের শরীরেও ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। বদ্ধ ঝুপড়িগুলিতে দীর্ঘক্ষণ থাকার ফলে হিমোগ্লোবিনের সঙ্গে কার্বন মনোক্সাইড মিশে যায়। যাতে তৈরি হয় কার্বোক্সিহিমোগ্লোবিন (সিওএইচবি)। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমে গিয়ে অনেক সময়েই রাস্তার ধারের ঝুপড়িতে খেতে বসে মাথা ঝিমঝিম করা বা খেয়ে
বেরোনোর পরে হঠাৎ খুব ক্লান্ত হয়ে পড়ার মতো ঘটনা ঘটে আকছার। ২২-৫৫ বছর বয়সি ক্রেতা-বিক্রেতার শরীরে কী হারে কার্বোক্সিহিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়তে পারে, সে সম্পর্কে নিরির তরফে ‘ম্যাথমেটিক্যাল মডেলিং’ করা হয়েছে। সেই পরীক্ষার ফল বলছে, কয়লার উনুনের সামনে একটানা থাকার ফলে দোকানদারদের শরীরে খুবই ক্ষতিকর প্রভাব হতে পারে।
এমনিতে ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশনের (ফাও) ২০১৮-র রিপোর্ট অনুযায়ী, কলকাতায় এক লক্ষ ৩০ হাজার খাবারের ঝুপড়ি রয়েছে। সেগুলির মধ্যে স্থায়ী দোকানের সংখ্যা এক লক্ষ ৪ হাজার। ফাও-এর রিপোর্ট আরও বলছে, ৩৩ শতাংশ ক্রেতাই রাস্তার ধারের ঝুপড়িগুলিতে খান। ২৩ শতাংশ আবার খান সপ্তাহে এক থেকে চার বার। ফলে দূষণের হাত থেকে কারও রেহাই নেই।
গবেষণার ক্ষেত্রে শহরের বিভিন্ন জায়গার ২৫টি ঝুপড়ি বেছে নিয়েছিল নিরি। সেগুলির আকার ও আকৃতি ছিল আলাদা। কোথাও তিন দিক বন্ধ, এক দিক খোলা (নিরির পরিভাষায় ‘ক্লোজ়ড টাইপ’)। কোথাও দু’দিক খোলা, দু’দিক বন্ধ (‘সেমি ক্লোজ়ড’) ঝুপড়িগুলির উপরে ওই গবেষণা করেছে তারা। ঝুপড়িগুলির মাপ ২৮-৪৬ বর্গফুট এবং সেগুলির মাটি থেকে ছাদের উচ্চতা ৬.১-৭.৯ ফুট। দিনের ব্যস্ততম সময়ে, অর্থাৎ সকাল, দুপুর ও রাতে খাবার সময়ে (পিক আওয়ার্স) এবং দিনের অন্য সময়ে (নন-পিক আওয়ার্স), আলাদা-আলাদা করে ‘পোর্টেবল কার্বন মনোক্সাইড মনিটর্স’ দিয়ে গবেষণা চলেছে।
কী বলছে গবেষণার ফল?
তিন দিক বন্ধ, এক দিক খোলা ঝুপড়িগুলির প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা গিয়েছে, কার্বন মনোক্সাইড নিঃসরণের মাত্রা ‘ইউনাইটেড স্টেটস এনভায়রনমেন্টাল প্রোটেকশন এজেন্সি’-র (ইউএসইপিএ) নির্ধারিত মাত্রা ৯ পিপিএম (পার্টস পার মিলিয়ন) থেকে কয়েক গুণ বেশি। আর ‘সেমি ক্লোজ়ড’ ঝুপড়িগুলির ৭১ শতাংশ ক্ষেত্রে ওই মাত্রা লঙ্ঘিত হয়েছে। বদ্ধ জায়গায় কার্বন মনোক্সাইডের নির্ধারিত মাত্রা যেহেতু কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের তরফে উল্লেখ করা নেই, তাই নিরির তরফে এ ক্ষেত্রে ইউএসইপিএ-র নির্ধারিত মাত্রাকেই মাপকাঠি ধরা হয়েছিল।
দোকানদারদের জিজ্ঞাসা করে নিরি জানতে পেরেছে, মহিলা-পুরুষ দোকানদার সহ সকলেই কম-বেশি মাথাব্যথা, ঝিমুনি, কাশি, শ্বাসকষ্ট, দৃষ্টিশক্তিতে সাময়িক সমস্যা প্রভৃতি একাধিক শারীরিক উপসর্গে ভুগছেন। নিরি-র বিজ্ঞানী দীপাঞ্জন মজুমদারের কথায়, ‘‘বদ্ধ ঝুপড়িগুলিতে বেশি ক্ষণ থাকলে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে গিয়ে কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যায়, যার জন্য ক্লান্ত বা ঝিম ভাব আসতে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে কাজে। একই সঙ্গে স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেও জটিলতা তৈরি হয়। ক্ষতিকর প্রভাব কমানোর জন্য ঝুপড়িগুলিতে হাওয়া চলাচলের আরও বেশি করে ব্যবস্থা রাখা দরকার। কিন্তু সেটা আর হয় কোথায়?’’