রাহুল প্রধান
ময়না-তদন্তকারী চিকিৎসকের বয়ানেই ঘুরে গিয়েছিল ঘটনার মোড়। জলে ডুবে মৃত্যুর ঘটনা বদলে গিয়েছিল খুনের মামলায়। সেই সঙ্গে গ্রেফতার করা হয়েছিল মৃতের দুই সহকর্মীকে। আপাতত জেল হেফাজতে রয়েছেন তাঁরা। তবে গ্রেফতারের প্রায় দু’মাস পরেও জানা গেল না খুনের কারণ। সন্ধান মিলল না পলাতক আরও তিন অভিযুক্ত সহকর্মীরও।
পুলিশ সূত্রের খবর, গত ২০ জানুয়ারি দক্ষিণ শহরতলির বিষ্ণুপুরের একটি বাগানবাড়িতে পিকনিক করতে গিয়েছিলেন শহরের এক পাঁচতারা হোটেলের কর্মীরা। রাহুল প্রধান (২৫) নামে ওই হোটেলের প্রধান বাবুর্চি পুকুরে স্নান করতে গিয়ে তলিয়ে যান। স্থানীয় বাসিন্দা ও পুলিশ জাল ফেলে দেহ উদ্ধার করেন। অস্বাভাবিক মৃত্যুর মামলা দায়ের করে তদন্ত শুরু করে পুলিশ। ওই পিকনিকে উপস্থিত অন্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, মদ খেয়ে স্নান করতে নেমে তলিয়ে গিয়েছিলেন রাহুল।
মাস চারেক পরে মৃতের পরিজনদের হাতে ময়না-তদন্তের রিপোর্ট আসে। যেখানে ময়না-তদন্তকারী চিকিৎসক জানান, রাহুলের পাকস্থলীতে শুধু মদ পাওয়া গিয়েছে। শ্বাসযন্ত্র ও পাকস্থলীতে অতিরিক্ত জল ছিল না। তা ছাড়া রাহুলের গলায় ও ঘাড়ে আঙুলের ছাপ রয়েছে। শ্বাসরোধেই রাহুলের মৃত্যু হয়েছে। ওই চিকিৎসকের আরও ব্যাখ্যা, জলে পড়ার আগে রাহুলের মৃত্যু হয়েছিল।
এর পরেই আলিপুরের অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় বিচারকের এজলাসে রাহুলের পরিবারের তরফে মৃত্যুর ঘটনার পুনরায় তদন্তের আবেদন করা হয়। আদালত ওই আবেদন মঞ্জুর করে এবং বিষ্ণুপুর থানাকে পুনরায় তদন্তের নির্দেশ দেয়। মামলার তদন্তকারী অফিসার পরিবর্তন করা হয়।
বিষ্ণুপুর থানা সূত্রের খবর, ওই দিন পিকনিকে উপস্থিত রাহুলের সহকর্মীদের ফের জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। জানা যায়, ওই দিন রাহুল ও তাঁর কয়েক জন সহকর্মী পুকুরের পাশে বসে মদ্যপান করছিলেন। তখনই রাহুলের সঙ্গে তাঁদের বচসা হয়। তদন্তকারীদের বক্তব্য, সেই সময়ে কয়েক জন মিলে তাঁর গলা টিপলে অচৈতন্য হয়ে পড়েন রাহুল। তাঁকে পুকুরে ফেলে দেওয়া হয়। মদ খেয়ে পুকুরে পড়ে গিয়েছেন বলে হইচই শুরু করেন ওই সহকর্মীরা।
গত ১৭ অক্টোবর সোমেশ মোহন ও দিব্যরূপ বসু নামে দুই সহকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। ওই খুনে আরও তিন জন জড়িত বলে আদালতে দাবি করেছেন তদন্তকারী অফিসার। তবে তিন জনই পলাতক। বিষ্ণুপুর থানা সূত্রের খবর, ঘটনার দিন প্রায় ৫০ জনকে জেরা করা হয়েছিল। কিন্তু সকলেই বিষয়টি আড়াল করেছিলেন। ময়না-তদন্তের রিপোর্ট অনুযায়ী রাহুলের সহকর্মীদের চাপ দিতে ঘটনার সত্যতা সামনে আসে।
পুলিশ জানিয়েছে, সোমেশ ও দিব্যরূপ রাহুলের অধীনে কাজ করতেন। খুনের নির্দিষ্ট কারণ এখনও জানা যায়নি। তবে বচসার সময়ে রাহুলকে খুন করা হয়েছে, তা স্বীকার করেছেন ধৃতেরা।
অতিরিক্ত মুখ্য বিচারবিভাগীয় বিচারক ওই দু’জনের জামিনের আবেদন খারিজ করার পরে জেলা বিচারকের কাছে সেটি নিয়ে যান অভিযুক্তদের আইনজীবী বিপ্লব গোস্বামী ও বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায়। ভারপ্রাপ্ত জেলা বিচারক পুষ্পল শতপথীও জামিন খারিজ করেছেন। আলিপুর আদালতের মুখ্য সরকারি আইনজীবী রাধাকান্ত মুখোপাধ্যায় বলেন,“ঘটনায় আরও তিন অভিযুক্ত পলাতক। ধৃতদের জামিন মঞ্জুর হলে পলাতকেরা আদালতে আত্মসমর্পণ করে জামিন পেতে পারে। কিন্তু ওই খুনের কারণ খুঁজতে ওই তিন জনের গ্রেফতারের প্রয়োজন রয়েছে।” ধৃতদের আইনজীবীরা বলেন, “দু’জন প্রায় দু’মাস জেল হেফাজতে রয়েছেন। তদন্তে সহযোগিতা করেছেন। খুনের কারণও জানা যায়নি। সে জন্যই জামিনের আবেদন করা হয়েছিল।”
পুলিশ জানিয়েছে, বছর দু’য়েক আগে রাহুলের বিয়ে হয়েছিল। তাঁর স্ত্রী ওই হোটেলে কাজ করতেন। বিয়ের পরে চাকরি ছেড়ে দেন। তদন্তে নেমে সেই দিকও খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলে জানাচ্ছেন তদন্তকারীরা।