অশোভন উন্মত্ততায় স্বরূপ প্রকাশ তৃণমূলের

ভোট মিটলেও শহরে রাজনৈতিক অশান্তি অব্যাহত। শনিবার রাত থেকেই একের পর এক অভিযোগ— কোথাও তা শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, কোথাও বিজেপি ও সিপিএম সমর্থকদের সঙ্গে শাসক দলের কর্মীদের সংঘর্ষ। এমনকী তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কোথাও এমন আকার নিয়েছে যে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপের পরেও তা মেটেনি।

Advertisement
নিজস্ব সংবাদদাতা শেষ আপডেট: ২০ এপ্রিল ২০১৫ ০৩:১৯
Share:

অফিস দখল করে এ ভাবেই লাগানো হয়েছে হোর্ডিং। রবিবার, টালিগঞ্জে। — নিজস্ব চিত্র।

ভোট মিটলেও শহরে রাজনৈতিক অশান্তি অব্যাহত। শনিবার রাত থেকেই একের পর এক অভিযোগ— কোথাও তা শাসক দলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, কোথাও বিজেপি ও সিপিএম সমর্থকদের সঙ্গে শাসক দলের কর্মীদের সংঘর্ষ। এমনকী তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব কোথাও এমন আকার নিয়েছে যে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপের পরেও তা মেটেনি। রবিবার যেমন ঘটেছে কলকাতার ৮১ নম্বর ওয়ার্ডের টালিগঞ্জ রোড এলাকায়, তৃণমূল বিধায়ক এবং বিধানসভায় দলের মুখ্য সচেতক শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের অনুগামীদের সঙ্গে স্থানীয় তৃণমূল নেতা তথা যুবকল্যাণ মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের ভাই স্বরূপ বিশ্বাস ও তাঁর অনুগামীদের সংঘাতের ঘটনায়। যে ঘটনার কথা শোভনদেববাবু দলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে এবং স্বরূপবাবু দলের সর্বভারতীয় সম্পাদক সুব্রত বক্সীকে জানিয়েছেন বলে দাবি করেছেন তাঁরা।

Advertisement

এ দিন দুপুর সাড়ে ১২টা নাগাদ স্বরূপ বিশ্বাসের নেতৃত্বে তাঁর শ’খানেক অনুগামী চারু মার্কেট থানা ঘেরাও করে। অভিযোগ, প্রায় পাঁচ ঘণ্টার উপর থানায় জোর করে আটকে রাখা হয় শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের ১২ জন অনুগামীকে। খবর পেয়ে শোভনদেববাবু বিষয়টি দলনেত্রীকে জানালে মমতার হস্তক্ষেপেই ওই ১২ জনকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এখানেই অবশ্য শেষ নয়। একই সময়ে টালিগঞ্জ রোডে শোভনদেববাবুর দলীয় কার্যালয়ে ঢুকে ভাঙচুর চালিয়ে অফিসে তালা দিয়ে নিজেদের দখলে নেওয়ার অভিযোগও উঠেছে স্বরূপবাবুরই আর এক দল অনুগামীর বিরুদ্ধে। আরও অভিযোগ, রাত পর্যন্ত অফিসটির সামনেই ছিলেন তাঁরা। থমথমে হয়ে রয়েছে এলাকাও। চারু মার্কেট থানায় দু’পক্ষই পরস্পরের বিরুদ্ধে হুমকির অভিযোগ দায়ের করেছে। যদিও পুলিশ এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হয়নি।

ঘটনার সূত্রপাত শনিবার, কলকাতার পুর-ভোট মেটার পর। অভিযোগ, ওই রাতে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের অনুগামী, টালিগঞ্জ রোডের বাসিন্দা ধর্মেন্দ্র সিংহের সঙ্গে বচসায় জড়িয়ে পড়েন স্বরূপ বিশ্বাসের অনুগামীরা। শোভনদেব-অনুগামীদের অভিযোগ, পুরভোটে দলের হয়ে প্রচারে সে ভাবে থাকতে না পারায় ধর্মেন্দ্রকে গালিগালাজ করেন স্বরূপ-অনুগামীরা। তাঁদের কথা শুনে না চললে ফল ভাল হবে না বলেও হুমকি দেওয়া হয় ধর্মেন্দ্রকে। এর পরে রাতেই ধর্মেন্দ্রকে নিয়ে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়ের অনুগামী কৌশিক মিত্র ও সৌমেন মালাকারের নেতৃত্বে একটি দল চারু মার্কেট থানায় যায় অভিযোগ জানাতে। ধর্মেন্দ্র সিংহকে হুমকি দেওয়ার অভিযোগে সোমনাথ বিশ্বাস নামে স্বরূপ বিশ্বাস গোষ্ঠীর এক সমর্থকের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন তাঁরা। কৌশিক এবং সৌমেনের দাবি, রাতে পুলিশের কাছে অভিযোগ জানানোর পরে তাঁরা ভেবেছিলেন নিজেদের মধ্যেই বিষয়টি মিটে যাবে।

Advertisement

তা যে হয়নি, সৌমেনরা সে কথা বুঝতে পারেন রবিবার সকালে, থানায় কেস নম্বর আনতে গিয়ে। এ দিন সকাল সাড়ে ১০টা নাগাদ ধর্মেন্দ্রকে নিয়ে তাঁরা ফের চারু মার্কেট থানায় যান। শোভনদেব-অনুগামীদের অভিযোগ, তাঁরা থানায় গিয়েছেন, সে খবর পেয়ে যান স্বরূপ-গোষ্ঠীর লোকেরা। এর পরেই দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে ঘণ্টাখানেক স্বরপ বিশ্বাসের নেতৃত্বে শ’খানেক সমর্থক থানার বাইরে বিক্ষোভ দেখান। এর জেরে থানার গেট বন্ধ রাখতে হয় পুলিশকে। আরও অভিযোগ, স্বরূপ অনুগামী আর একটি দল ওই সময়েই চলে যায় ৫৮/১এ, টালিগঞ্জ রোডে, কৌশিকের বাড়িতে। কৌশিকের বাড়ি এবং তার উল্টো দিকে ঝালার মাঠ সংলগ্ন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় গোষ্ঠীর অফিসঘরটিতে হামলা চালানো হয়। অভিযোগ, দলটি ওই অফিসের তালা ভেঙে ভিতরে ঢুকে ভাঙচুর চালায়। পরে নিজেরা বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে, ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জুঁই বিশ্বাস এবং স্বরূপ বিশ্বাসের সমর্থনে পোস্টার লাগিয়ে আসে। রাত পর্যন্ত অফিসটি তাঁদেরই দখলে থাকে।

পরে কৌশিকের স্ত্রী মৌসুমী মিত্র অভিযোগ করেন, স্বরূপ বিশ্বাস এবং স্থানীয় তৃণমূল প্রাথী জুঁই বিশ্বাসের দলবল প্রথমে তাঁদের বাড়ি লক্ষ করে ইট ছোড়ে। পরে বাড়ির ভিতরে থাকা একটি গাড়িতেও ভাঙচুর চালানো হয়। কৌশিকের দাবি, তিনি এলাকায় দলের হয়ে কাজ করতে চাইলে তাতে বাধা দিচ্ছেন স্বরূপ-গোষ্ঠী।

পুলিশ জানিয়েছে, কৌশিক থানায় গেলে স্বরূপ গোষ্ঠীর শ’খানেক সমথর্ক চারু মার্কেট থানা ঘেরাও করে বিক্ষোভ দেখাতে থাকেন। থানার সামনে দাঁড়িয়ে স্বরূপের দাবি, পুরো ঘটনার কথা তিনি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বক্সীকে জানিয়েছেন। পরে শোভনদেব চট্টোপাধ্যায় জানান, তিনি মুখ্যমন্ত্রীকে যা জানানোর জানিয়েছেন। তবে মন্ত্রী অরূপ বিশ্বাসের কোনও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। রবিবার রাতে বার বার ফোন করা হলে, তিনি মিটিংয়ে ব্যস্ত বলে এক তৃণমূল সমর্থক জানিয়ে দেন।

শুধু চারু মার্কেট নয়। শনিবার ভোট-পর্ব মেটার পরে রাতেই শাসকদলের দুই গোষ্ঠীর সংঘর্ষ বাধে ১০১ নম্বর ওয়ার্ডের কেন্দুয়া মোড়ে। অভিযোগ, বুথে কেন তাঁদের এজেন্ট হিসেবে বসতে দেওয়া হয়নি, সেই প্রশ্ন তুলে দলের একটি গোষ্ঠী চড়াও হয় এলাকার তৃণমূল প্রার্থী বাপ্পাদিত্য দাশগুপ্তের সমর্থকদের উপরে। তবে এ দিন প্রার্থী নিজে জানিয়েছেন, শনিবার রাতে দলের সমর্থকদের মধ্যে সামান্য একটি বিবাদ বাধে, বড় কিছু নয়।

অশান্তি ছড়ায় শাসক-বিরোধী গোলমালেও। অভিযোগ, বাগবাজার স্ট্রিটে একটি হোটেলে বিজেপি সমর্থকেরা ভাঙচুর করে। হোটেল কর্মীকে মারধরও করা হয়। পরে রবিবার সকালে ঘটনার সঙ্গে জড়িত বিজেপি-র এক সমর্থকের বাড়িতে হামলা ও মারধরের অভিযোগ ওঠে তৃণমূল সমর্থকদের বিরুদ্ধে।

বিজেপি-র আরও অভিযোগ, ১০৪ নম্বর ওয়ার্ডের দলীয় প্রার্থী তাপস ধরের মুখ্য নির্বাচনী এজেন্ট নির্মল ঘোষকে তৃণমূলের লোকেরা এমন মারধর করে যে, তিনি অজ্ঞান হয়ে যান। তাপসবাবু নিজে ঘরছা়ড়া ও তাঁর গাড়িচালকও মারে আহত বলে অভিযোগ।

মহেশতলা পুর-এলাকায় এ দিন রোড শো ছিল বিজেপি রাজ্য সভাপতি রাহুল সিংহের। তা চলাকালীন পুলিশ মিছিলে আসা মোটরবাইক ধরতে শুরু করে। এর জেরে বিজেপি কর্মীরা রাস্তা অবরোধ করেন। পরে পুলিশ বাইকগুলি ছেড়ে দেয়। রাহুলবাবু বলেন, ‘‘এ ভাবে রোড শো ভেস্তে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। যতটা এলাকা এ দিন আমরা পরিক্রমা করতে পারতাম, পুলিশের জন্য তা করতে পারিনি।’’ যদিও পরে ওসি ফোন করে রাহুলবাবুকে জানান, রোড-শো ব্যাহত করতে বাইক ধরা হয়নি। রাহুলবাবু অবশ্য সে কথা মানতে নারাজ।

এ দিনই ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে তৃণমূলের মারে শিবশঙ্কর দাস নামে এক বিজেপি কর্মী জখম হন বলে অভিযোগ। আরও অভিযোগ, ওয়ার্ডে দলের ১৫ জন কর্মী-সমর্থক ঘরছাড়া। একই দিনে সিপিএমের প্রাক্তন কাউন্সিলর চন্দনা ঘোষ দস্তিদার পাটুলি থানায় অভিযোগ করে জানান, রবিবার বিকেলে গাঙ্গুলিবাগানে তাঁর বাড়ির জানালার কাচ কেউ ফাটিয়ে দেয়। তিনি বেরিয়ে দেখেন, তিনটি ছেলে মোটরবাইকে পালিয়ে যাচ্ছে। এর পরেই থানায় অভিযোগ দায়ের করে চন্দনাদেবী জানান, তৃণমূলের নেতৃত্বে তারক দাসের দলবলই এই কাণ্ড ঘটিয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, অভিযোগ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তবে উল্টো অভিযোগও রয়েছে। এ দিনই আনন্দপুর থানার মুণ্ডাপাড়ায় তৃণমূলের দলীয় কার্যালয় ভাঙচুর করা হয় বলে থানায় অভিযোগ দায়ের হয়। অভিযোগের তির সিপিএমের দিকে।

শাসক দলের বিরুদ্ধে হামলার অভিযোগ উঠেছে খড়দহেও। অভিযোগ, রবিবার সিপিএমের একটি মিছিলে রড, লাঠি নিয়ে হামলা চালায় তৃণমূল। ঘটনায় আহতদের মধ্যে ৭ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক, যাঁদের মধ্যে রয়েছেন খড়দহ এলাকার পুরভোটে সিপিএমের দুই প্রার্থীও।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement