গুদামের শাটার খুলতেই চোখে পড়ল, থরে থরে সাজানো ওয়্যারলেস সেট। একটা হাতে তুলে নব ঘোরালেন তিনি। তার পর? পরিষ্কার শোনা গেল, কলকাতা পুলিশের দুই অফিসারের কথোপকথন!
শুধু ওয়্যারলেস কেন, কাঁকুড়গাছি এলাকায় তাঁর ‘দুকানে’ সার দিয়ে সাজানো ‘বেস স্টেশন’ ‘অ্যানালাইজার’-সহ কত কী! সেনা, পুলিশ, আধাসেনা, রেলের কর্তারাই মূলত ব্যবহার করেন এ সব। হাজারো নিয়মকানুন মেনে সাধারণ নাগরিকেরাও ব্যবহার করার অনুমতি পান। কিন্তু এ দোকানে যে সে-সব নিয়মের বালাই নেই, তা খোলাখুলিই বলেন তিনি— ‘সমঝদারেরা’ যাঁকে সন্টু রাম নামেই চেনে।
এক বন্ধুর কাছে শুনেছিলাম, সন্টুর কারবারের কথা। স্বচক্ষে দেখতে বন্ধুকে নিয়ে তাঁর ডেরায় হাজির হওয়া। শর্ত ছিল, সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে যেতে হবে এবং দু’জনের বেশি যাওয়া যাবে না। আরও বলা হয়েছিল— ডেরায় আধ ঘণ্টার বেশি থাকা যাবে না। ‘জিনিস’ নিয়ে দরদস্তুরও নিষিদ্ধ।
বৃষ্টিভেজা শহর তখন আড়মোড়া ভাঙছে। ঘড়ির কাঁটা ৭টা ছোঁয়ার আগেই সন্টুর ‘দুকানে’ গিয়ে দেখলাম, দু’টো ট্যাক্সির ডিকিতে বস্তা বোঝাই হচ্ছে। ট্যাক্সি বিদায় করে গুদামের শাটার তুললেন তিনি। কথাবার্তা শুরু হওয়ার আগেই হাজির হলেন আরও এক যুবক। তিনিই প্রশ্ন করলেন, ‘‘চালু সেট আছে তো?’’ কয়েকটি সেট সামনে নিয়ে এলেন সন্টু। বললেন, ‘‘তিন ধরনের সেট। দাম ১৩০০, ১৫০০ এবং ১৭০০ টাকা। ‘বেস স্টেশন’ ২২০০ টাকা থেকে শুরু।’’ সন্টুর গ্যারান্টি, টাকা নিয়ে ‘বেকার চিজ়’ দেবেন না তিনি।
এ সব সন্টুর কাছে এল কী করে? মুচকি হেসে জবাব, “খরিদ কে লাতে হ্যায়। খাস সেটিং হ্যায় হমারা।” দাবি করলেন, আগে বিএসএফের জিনিস নিয়ে কারবার করতেন। এখন কলকাতা পুলিশের ‘মাল’ বেচেন।
খদ্দের কারা? সন্টুর জবাব, “আপ জ্যায়সা লোগ তো দো-চার হি লেতে হো। সব গাড়ি ভরকে লে যাতে হ্যায়। আভি আভি দো ট্যাক্সি মে গ্যয়া। আপলোগ দেখা তো।” আরও একটি সেট চালু করতেই স্ক্রিনে লেখা ফুটে উঠল, ‘কোল পোল’। আওয়াজ শুনে বুঝলাম, কলকাতা পুলিশের ট্রাফিক সার্জেন্টরা কথা বলছেন।
এই কারবারের কথা শুনে আঁতকে উঠলেন কেন্দ্রীয় যোগাযোগ মন্ত্রকের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক
বিশ্বনাথ চট্টোপাধ্যায়। বললেন, “এ ভাবে এই যন্ত্রপাতি বিক্রি শুধু বেআইনি নয়, দেশের নিরাপত্তার পক্ষে বিপজ্জনকও।” তিনি জানান, ‘কমার্শিয়াল’ এবং ‘অ্যামেচার’, মোট দু’ধরনের লাইসেন্স হয়। যন্ত্র বাতিল হলে লাইসেন্সের কপি-সহ অকেজো সেটের সিরিয়াল নম্বর দিয়ে নষ্ট করার জন্য আবেদন করতে হয়। মন্ত্রকের আধিকারিকদের সামনেই যন্ত্র নষ্ট করতে হয়। ওয়্যারলেস বিক্রি করতে পারেন শুধু মন্ত্রক
অনুমোদিত ডিলারেরা।
গোয়েন্দা সূত্রের খবর, মাওবাদীরা এই যন্ত্র ব্যবহার করে নিজেদের মধ্যে কথা বলত। মোর্চা নেতা বিমল গুরুং পালিয়ে বেড়ানোর সময়ে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে ওয়্যারলেস সেটের মাধ্যমেই যোগাযোগ রাখতেন বলে দাবি করছেন অনেকে। তা বলে খাস কলকাতায় এমন কারবার?
এ ব্যাপারে কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধদমন) প্রবীণ ত্রিপাঠীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘‘যা বলার ডিসি (ওয়্যারলেস) বলবেন।’’ ডিসি (ওয়্যারলেস) জয়িতা বসুর বক্তব্য, ‘‘কলকাতা পুলিশের ওয়্যারলেস সেট এ ভাবে বাইরে বিক্রি হয় না। বিষয়টি খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।’’