হদিস দিল শাগরেদ ছোট্টুই

গোপালের বাড়িতে অস্ত্রাগার, সিসিটিভি

একটা ঘরে ব্যাগভর্তি গুলি-বোমার মশলা। সাজানো রয়েছে একাধিক পিস্তলও। সেই সব অস্ত্রশস্ত্রে নজরদারির জন্য রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এ যেন পুরোদস্তুর ‘অস্ত্রাগার’! পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের বাড়িটি অবশ্য কোনও সেনাবাহিনীর নয়। বাড়ির কর্তাও নন কোনও সেনা কম্যান্ডার। তাঁর নাম গোপাল তিওয়ারি। গিরিশ পার্কে সাব-ইনস্পেক্টরের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় মধ্য কলকাতার কুখ্যাত দুষ্কৃতী এই গোপালকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। সেই সূত্রেই শুক্রবার সকালে গোপালের বাড়িতে হানা দেন লালবাজারের হোমিসাইড ও গুন্ডাদমন শাখার গোয়েন্দারা।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ০২ মে ২০১৫ ০১:৫৮
Share:

উদ্ধার হওয়া অস্ত্র। —নিজস্ব চিত্র।

একটা ঘরে ব্যাগভর্তি গুলি-বোমার মশলা। সাজানো রয়েছে একাধিক পিস্তলও। সেই সব অস্ত্রশস্ত্রে নজরদারির জন্য রয়েছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এ যেন পুরোদস্তুর ‘অস্ত্রাগার’!
পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটের বাড়িটি অবশ্য কোনও সেনাবাহিনীর নয়। বাড়ির কর্তাও নন কোনও সেনা কম্যান্ডার। তাঁর নাম গোপাল তিওয়ারি।
গিরিশ পার্কে সাব-ইনস্পেক্টরের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনায় মধ্য কলকাতার কুখ্যাত দুষ্কৃতী এই গোপালকে হন্যে হয়ে খুঁজছে পুলিশ। সেই সূত্রেই শুক্রবার সকালে গোপালের বাড়িতে হানা দেন লালবাজারের হোমিসাইড ও গুন্ডাদমন শাখার গোয়েন্দারা। সেখানেই একতলার সিঁড়ির নীচে ওই অস্ত্রাগারের সন্ধান পেয়েছেন তাঁরা।
কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান পল্লবকান্তি ঘোষ জানান, গোপালের বাড়ি থেকে প্রায় সাড়ে ৬ কেজি বোমার মশলা-সহ দু’টি ৭এমএম পিস্তল, একটি ৯এমএম পিস্তল, একটি দেশি ওয়ান শটার পিস্তল, পাঁচটি ম্যাগাজিন, ১০১ রাউন্ড কার্তুজ বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।
ওই অস্ত্রাগার দেখে তাক লেগে গিয়েছে গোয়েন্দাদের। তাঁরা বলছেন, ওই ঘর থেকে স্‌প্লিন্টারও উদ্ধার করা হয়েছে। যা দেখে পুলিশের অনুমান, ঘরটিতে বসে বোমাও বাঁধা হতো। এক গোয়েন্দা কর্তা বলেন, ‘‘সাড়ে ৬ কেজি বোমার মশলা একবারে ফেটে গেলে ছ’তলা বাড়িটা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ত। তা হলে মধ্য কলকাতার ঘিঞ্জি এলাকায় ফের একটা বৌবাজার-কাণ্ড ঘটতে পারত।’’ ঘরটি দেখভাল করতেন বাড়ির দারোয়ান। তাঁকে জেরা করছেন গোয়েন্দারা।

Advertisement

পুলিশ সূত্রের খবর, বীরভূমের নলহাটির বারা গ্রামে গোপালের মামাবাড়ি। ঘটনার পর থেকেই গোপাল ও তার শাগরেদদের ওই এলাকায় আনাগোনার কথা জানতে পেরেছিলেন তদন্তকারীরা। সেই সূত্রে ইতিমধ্যেই নলহাটি, তারাপীঠ ও সংলগ্ন এলাকায় কয়েক বার হানা দিয়েছেন লালবাজারের গোয়েন্দারা। কিন্তু কোনও বারই গোপালের হদিস মেলেনি। ফের একটি গোপন সূত্রে খবর পেয়ে বৃহস্পতিবার রাতে নলহাটিতে হানা দেন গোয়েন্দারা। ওই গ্রাম থেকেই ধরা পড়ে সমীর দাস ওরফে ছোট্টু নামে এক দুষ্কৃতী। সে গোপালের ‘ডান হাত’ বলে পুলিশের দাবি। জানা গিয়েছে, ছোট্টুর আসল বাড়ি নলহাটি থানার বুজুং গ্রামে। কলকাতায় পাথর সরবরাহের ব্যবসা আছে তার। বুধবারই বারা গ্রামে ডেরা নিয়েছিল সে। তার কাছ থেকে কোনও আগ্নেয়াস্ত্র না মিললেও, গোয়েন্দারা জানান, ছোট্টুকে জেরা করে গোপালের বাড়িতে লুকনো অস্ত্রাগারের হদিস মেলে।

বৃহস্পতিবার রাতেই নলহাটি থেকে ছোট্টুকে কলকাতায় আনা হয়। সে-ই গোপালের বাড়ির একতলায় ঘরটি দেখিয়ে দেয়। সেই ঘরেই হদিস মেলে অস্ত্র ও বিস্ফোরকের। তখনই ঘরে সিসিটিভি ক্যামেরা দেখে তাজ্জব হয়ে যান তদন্তকারীরা। সেই সূত্র ধরে খুঁজতে গিয়ে তাঁরা দেখেন, তিনতলায় গোপালের বসার ঘরে বিরাট মনিটর লাগানো রয়েছে। যেখানে বসে ওই ‘অস্ত্রাগারে’ নজরদারি চালাত গোপালই। গোপালের ঘর থেকে উদ্ধার হয় সিসিটিভির হার্ডডিস্কটিও। সেটি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে।

Advertisement

কিন্তু ১৮ এপ্রিল গুলিচালনার ঘটনার পর থেকে গোপালের বাড়িতে লালবাজারের গোয়েন্দারা একাধিক বার তল্লাশি চালিয়েছিলেন। তখন তাঁরা অস্ত্রাগারের হদিস পাননি কেন?

এ প্রসঙ্গে লালবাজারের একাংশের অভিযোগের আঙুল তাঁদেরই কয়েক জন সহকর্মীর দিকে। পুলিশ সূত্রের খবর, গুন্ডাদমন শাখার এক ইনস্পেক্টর ও তাঁর কয়েক জন ঘনিষ্ঠের সঙ্গে গোপালের সুসম্পর্ক ছিল। জগন্নাথবাবু গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরে ওই ইনস্পেক্টরই গোয়েন্দাকর্তাদের কাছে গোপালের হয়ে তদ্বির করতে গিয়েছিলেন। কলকাতা পুলিশের এক অফিসার বলেন, ‘‘ওই ইনস্পেক্টর কয়েক জন শীর্ষকর্তার সুনজরে থাকলেও গোপালকে ধরতে সে দিন এককাট্টা হয়েছিলেন লালবাজারের গোয়েন্দারা।’’ গোপালের বাড়িতে এত দিন তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্রাগারের সন্ধান না পাওয়ার পিছনেও সেই ইনস্পেক্টরকে দায়ী করছেন গোয়েন্দাদের একাংশ। তাঁরা বলছেন, হয়তো ওই অফিসারই পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে তল্লাশিকারীদের বিভ্রান্ত করেছিলেন।

কিন্তু গোপালকে কবে গ্রেফতার করা যাবে? প্রশ্ন উঠেছে, শাসক দলের ছত্রছায়ায় থাকার ফলেই কি গোপালকে ধরার ক্ষেত্রে ‘ধীরে চলো’ নীতি নেওয়া হয়েছে? গুলিচালনার এই ঘটনায় ইতিমধ্যে গ্রেফতার হয়েছে অশোক শাহ ও দীপক সিংহ নামে দুই তৃণমূলকর্মী-সহ গোপালের চার জন শাগরেদ। তদন্তে জানা যায়, শাসক দলের হয়েই ভোটে কাজ করছিল গোপাল ও তার দলবল। ওই এলাকায় শাসক দলের নেতা সঞ্জয় বক্সীর সঙ্গেও গোপালের ঘনিষ্ঠতার কথা উঠে আসে। যদিও সঞ্জয়বাবু সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। গ্রেফতার হওয়ার পরে ছোট্টুও তাদের পিছনে রাজনৈতিক যোগ থাকার স্বীকার করেছে বলে লালবাজার সূত্রের খবর। পুলিশকে ছোট্টু জানিয়েছে, ভোটের দিন সে সারাক্ষণ গোপালের সঙ্গে ছিল। পুলিশ তাদের খুঁজছে এটা জানতে পেরেই গোপালের নির্দেশে সে গা-ঢাকা দেয়।

তবে গোপালকে ধরতে না পারার পিছনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপই একমাত্র কারণ, মানতে নারাজ লালবাজার। বরং গোয়েন্দাদের একটি বড় অংশ বলছেন, গোপালকে জালে ফেলার আগে আটঘাট বেঁধে নামা হচ্ছে। সে কারণেই তার প্রোমোটারি ব্যবসার কাগজপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। তার উপরে এই অস্ত্রাগারের হদিস মেলায় গোপালের চার দিকে দড়ির ফাঁস আরও জোরালো হল বলেও লালবাজারের দাবি। ‘‘গোপালের ডান হাত ধরা পড়েছে। ছোট্টুর সঙ্গে গোপালের ফোনে কথা বলার প্রমাণও আমরা পেয়েছি। তাই খুব বেশি দিন সে আমাদের নাগাল এড়িয়ে থাকতে পারবে না,’’ মন্তব্য এক গোয়েন্দা কর্তার।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement