অভিযুক্ত ওসি পুলক দত্ত এবং আক্রান্ত চিকিৎসক শ্রীনিবাস গেদ্দেম।—নিজস্ব চিত্র।
চিকিৎসক-নিগ্রহের ক্ষেত্রে অপরাধের আইনি ধারা নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে কলকাতা পুলিশ। সেখানে চিকিৎসককে ‘সমাজবন্ধু’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু বুধবার রাতে একবালপুরের এক বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক-নিগ্রহের অভিযোগ উঠেছে খোদ কলকাতা পুলিশেরই এক কর্তার বিরুদ্ধে।
সেই ঘটনার কথা জানাজানি হতেই চিকিৎসক মহলে প্রশ্ন উঠেছে, যে পুলিশের দায়িত্ব নিরাপত্তা দেওয়ার, সেই পুলিশের বিরুদ্ধেই যখন নিগ্রহের অভিযোগ ওঠে, তখন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে এতটা অনীহা দেখা যায় কেন? ওই ঘটনার পরে প্রায় ২৪ ঘণ্টা কেটে গেলেও গ্রেফতারি তো দূর, অভিযুক্তের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপও করা হয়নি। চিকিৎসকদের আরও প্রশ্ন, যে সব দুষ্কৃতী হাসপাতালে গোলমাল পাকায়, এতে কি তারা আরও উৎসাহ পাবে না?
চিকিৎসকদের সংগঠন ‘অ্যাসোসিয়েশন অব হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স’-এর তরফে চিকিৎসক মানস গুমটা বলেন, ‘‘পুলিশই যদি মারধর করে, তা হলে নিরাপত্তা দেবে কে? রাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও পুলিশমন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন না? অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হোক। চিকিৎসকদের নিগ্রহের ঘটনায় কেউই যে ছাড়া পাবেন না, সেটা তুলে ধরা জরুরি।’’ চিকিৎসকদের আর এক সংগঠন ‘ডক্টর্স ফর পেশেন্ট’-এর তরফে চিকিৎসক শারদ্বত মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অভিযুক্তকে গ্রেফতার ও সাময়িক ভাবে বরখাস্ত করতে হবে। পুলিশের দায়িত্ব নিরাপত্তা দেওয়ার। এ দিকে পুলিশের হাতেই নিগ্রহের অভিযোগ উঠছে। এটা দুর্ভাগ্যের।’’
বেসরকারি হাসপাতালের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে এই ঘটনা যথেষ্ট উদ্বেগজনক বলেই মত শহরের আর একটি বেসরকারি হাসপাতালের কর্তা রূপক বড়ুয়ার। তিনি বলেন, ‘‘অনেক ক্ষেত্রে পুলিশের সক্রিয়তায় বড় বিপদ এড়ানো গিয়েছে। কিন্তু বুধবারের ঘটনা দুঃখজনক। পুলিশ ও চিকিৎসকেরা একসঙ্গে যে সঙ্কটজনক পরিস্থিতির বিরুদ্ধে লড়াই করছিলেন, সেটা মুখ থুবড়ে পড়বে না তো!’’
তবে, বুধবারের ঘটনাকে ব্যতিক্রম হিসেবেই দেখছেন চিকিৎসকদের সংগঠন ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য শাখার সম্পাদক ও তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সদস্য শান্তনু সেন। তিনি বলেন, ‘‘সব পুলিশ খারাপ নয়। তাই উদ্বেগের কোনও কারণ নেই। চিকিৎসক ও হাসপাতালের নিরাপত্তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী সতর্ক। আশা রাখছি, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করা হবে।’’
স্বাস্থ্য দফতর অবশ্য এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে নারাজ। একাধিক কর্তাকে যোগাযোগ করলেও উত্তর মেলেনি।
একবালপুরের ওই হাসপাতাল সূত্রে খবর, দিন দু’য়েক আগে পুলক দত্ত নামে কলকাতা পুলিশের ওই অফিসার হাতে গুরুতর চোট নিয়ে সেখানে ভর্তি হন। তাঁর অস্ত্রোপচার হয়। বুধবার সন্ধ্যায় স্নাতকোত্তর প়ড়ুয়া শ্রীনিবাস তাঁর চিকিৎসা সংক্রান্ত পুরনো তথ্য জানতে যান। অভিযোগ, কোনও রোগ রয়েছে কি না, প্রতিদিন কোনও ওষুধ খান কি না, এ সব প্রশ্ন করতেই বিরক্ত পুলকবাবু বলেন, ‘‘কী ওষুধ খাই, আমি কেন বলব! ডাক্তার হয়েছ কেন!’ তার পরেও পুরনো ওষুধ খাওয়ার বিষয়ে ফের জানতে চাইতেই ওই পুলিশকর্তা চিকিৎসকের গলা চেপে ধরেন বলে অভিযোগ। নিগ্রহের ঘটনা প্রকাশ্যে আসার পরেই লালবাজারের কর্তারা হাসপাতালে যান। বিভাগীয় তদন্তের আশ্বাস দেন।
অভিযোগ, কর্তারা ফিরে যেতেই অভিযুক্ত পুলিশকর্তা ও তাঁর পরিবার হাসপাতাল থেকে ছুটি পেতে কর্তৃপক্ষকে চাপ দিতে থাকেন। বৃহস্পতিবার সকালে তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়া হয়।
কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (সদর) সুপ্রতিম সরকার বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার ডাক্তারদের এক প্রতিনিধিদল ডিসি (সাউথ)-র কাছে অভিযোগ দায়ের করেছে। সব দিক খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে পুলিশ বলে কোনও ছাড় দেওয়া হবে না।’’ গোয়েন্দা-প্রধান প্রবীণ ত্রিপাঠী বলেন, ‘‘চিকিৎসকের অভিযোগের ভিত্তিতে বিভাগীয় তদন্ত শুরু হচ্ছে।’’ বৃহস্পতিবার রাতে কলকাতা পুলিশের ফেসবুক পেজে পুলকবাবু লিখেছেন, বুধবার সন্ধ্যায় এক ভদ্রলোক তাঁর ঘরে ঢোকেন। তিনি ডাক্তারের পোশাক পরে ছিলেন না। তাই তাঁকে ফার্মাসির লোক ভেবেছিলেন তিনি। পুলকবাবুর দাবি, ওই ব্যক্তি তাঁকে ফার্মাসি থেকে ওষুধ নিয়ে আসতে বলেছিলেন। তাতেই তিনি মেজাজ হারিয়ে ফেলেন। তাঁর দাবি, ওই ভদ্রলোককে তিনি চড় মারেননি, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছিলেন। পুলকবাবু লিখেছেন, ‘‘ঘটনার পরে জানতে পারি, উনি ডাক্তার। আমার ব্যবহারে ওই চিকিৎসক আহত হয়ে থাকলে আমি দুঃখিত।’’