মাতোয়ারা: রাত যত বেড়েছে, ততই পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভিড়। রবিবার, পার্ক স্ট্রিটে। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক।
দৃশ্য এক: ক্রিসমাস টুপি মাথায় দেওয়া বছর দুয়েকের শিশুকে কাঁধে নিয়েই চিড়িয়াখানার টিকিটের লাইনে ভিড় ঠেলে এগোনোর চেষ্টা করছিলেন এক যুবক। দীর্ঘক্ষণ দাঁড়ানোর পরে শেষে বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘‘ভেবেছিলাম চিড়িয়াখানা ঘুরে ভিক্টোরিয়া যাব! কিন্তু গরমে যা অবস্থা, মনে হচ্ছে না সেটা হবে।’’
দৃশ্য দুই: দুপুরে পার্ক স্ট্রিটের এক রেস্তরাঁর সামনের লাইন ফুটপাত পেরিয়ে নেমে এসেছে রাস্তায়। ফুটপাতের ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাওয়া এক তরুণী বলে উঠলেন, ‘‘গরমে এখনই তো মেক-আপ উঠে যাচ্ছে! রাত পর্যন্ত মুখে মেক-আপ থাকবে বলে তো মনে হচ্ছে না।’’
চলতি বছরের বিধিহীন বড়দিনের ভিড় যে গত দু’বছরকে টেক্কা দেবে, তার আভাস মিলেছিল। তবে এ বার ডিসেম্বরের শেষেও যে ‘অকাল গরমের’ মুখ দেখবে শহর, সেটা ভাবা যায়নি। গত কয়েক বছরে বড়দিনের সকালে শহরের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ঘোরাফেরা করেছিল ১৫-১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে। বেলার দিকে সেই তাপমাত্রা বেড়ে হয়েছিল প্রায় ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এ বার সেই তাপমাত্রাই রইল ২৮.৭ ডিগ্রির আশপাশে! এ দিন সকালে শীত-পোশাক পরে বেরিয়ে কার্যত গলদঘর্ম হতে হল উৎসাহী জনতাকে। সকালে কিছুটা ঠান্ডা থাকলেও বেলা গড়াতেই তা উধাও। শেষ কবে বড়দিনে এত গরম ছিল, মনে করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞেরাও। ময়দানে এক তরুণী বলেই ফেললেন, ‘‘ডিসেম্বর না মার্চ, বোঝা মুশকিল! আগে জানলে সোয়েটার আনতামই না।’’ সন্ধ্যায় ভিড় ঠেলে আলো ঝলমলে পার্ক স্ট্রিট চষে বেড়ানো এক যুবকও বললেন, ‘‘সোয়েটার না পরে এলেই ভাল হত।’’
যদিও ‘অকাল গরম’কে উপেক্ষা করেই দিনভর ভিড় জমেছিল শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। সকালে কচিকাঁচাদের নিয়ে কেউ ভিড় জমালেন চিড়িয়াখানায়, কেউ ঘুরলেন জাদুঘর, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, প্রিন্সেপ ঘাটে। ময়দানেও ছিল পিকনিকের মেজাজ। দুপুরে ময়দানে গাছের নীচে বসে খাওয়াদাওয়া করছিল চন্দননগর থেকে আসাএকটি দল। সেই দলের এক জন বললেন, ‘‘চিড়িয়াখানা দেখে এখানে এলাম। একটু খেয়ে নিয়ে আলিপুরের নতুন মিউজ়িয়ামে যাব। রাতেপার্ক স্ট্রিট। আজ বাড়ি ফেরার তাড়া নেই। কিন্তু এই গরমে আর শরীরদিচ্ছে না।’’
একই ছবি সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল গির্জা, জাদুঘর, বিড়লা তারামণ্ডলের সামনে। এ দিন প্রথমে সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের প্রবেশপথ খোলা থাকলেও বেলার দিকে ভিড়ের চাপে ভিতরের দরজা কিছু ক্ষণের জন্য বন্ধ করে দিতে হয়। বেলার দিকে প্রিন্সেপ ঘাটে গিয়ে দেখা গেল, একটু বসার জায়গাও নেই। বন্ধুদের সঙ্গে নিজস্বী তুলতে ব্যস্ত মেঘনা ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘দু’বছর তো বাড়ি থেকে বেরোতেই পারিনি। এ বছর আসবই, ঠিক করে নিয়েছিলাম। তবে যা গরম, সোয়েটার পরে ছবি তুলতে পারছি কোথায়? সবই তো হাতে নিয়ে ঘুরতে হচ্ছে!’’ বড়দিনে এ বছর ভিড় টেনেছে আলিপুর জেল মিউজ়িয়ামও। বেলার দিকে টিকিটের লম্বা লাইনের দেখা মেলে ভিক্টোরিয়ায়।
তবে সন্ধ্যা নামতেই জনস্রোত উপচে পড়েছে পার্ক স্ট্রিটে। কালো কালো মাথার ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা ছিল না সেখানে। ঝাড়গ্রাম থেকে পাঁচ বছরের ছেলেকে নিয়ে আসা এক দম্পতি বললেন, ‘‘ভিড়ে বেশি দূর যেতেই পারিনি। অ্যালেন পার্ক পর্যন্ত পৌঁছনোর আগেই ফিরতে হল। এ তো দুর্গাপুজোর মণ্ডপের থেকেও বেশি ভিড়!’’
ভিড় সামলাতে ওয়াচ টাওয়ার থেকে নজরদারি করা ছাড়া পার্ক স্ট্রিটের পথেও পর্যাপ্ত সংখ্যক পুলিশকর্মী ছিলেন। তবু এক সময়ে ফুটপাতের ভিড় নেমে আসে রাস্তায়। ‘বুম ব্যারিয়ার’ দিয়ে ভিড় সামলানোর চেষ্টা হয়। একটা সময় পরে সেটাও কার্যত হাতের বাইরেচলে যায়।
তবে এই ভিড়ে মাস্ক পরার বালাই ছিল না প্রায় কারও। করোনা নিয়ে প্রশ্ন করতেই কেউ উত্তর দিয়েছেন, ‘‘ভোট আসছে, তাইকরোনা গুজব ছড়ানো হচ্ছে।’’ কারও আবার সপাট জবাব— ‘‘রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে গিয়েছে!আর কিছু হবে না।’’
তবে দিনের গরম পেরিয়ে সন্ধ্যার হালকা শীতে পার্ক স্ট্রিটে ভিড় সামলাতেসামলাতে এক পুলিশকর্মী বললেন, ‘‘গত বছর এই বড়দিনেরপরেই ওমিক্রন কী অবস্থা করেছিল, সবাই ভুলে গিয়েছে মনে হচ্ছে।এখন চিনে কাঁপাচ্ছে। বড়দিনের পরে এ বারও না আবার আগেরঅবস্থা হয়!’’