—প্রতীকী চিত্র।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকেই শুরু হয়েছিল উৎকণ্ঠা। সাড়ে চার বছর আগের আমপান-বিভীষিকার স্মৃতি মনে মনে খুঁচিয়ে তোলা চলছিল। শুক্রবার ভোরে শুরু হল বৃষ্টি। কিন্তু ঝড় কই? মহানগরে এক ধরনের বিরক্তির সুরই প্রধান হয়ে উঠল! ধুর কী লাভ হল, আগের সন্ধ্যার কত জরুরি কাজ স্থগিত রেখে! এখন কালীপুজো, ভাইফোঁটার ছুটিতে আবার সেই না-হওয়া মিটিংয়ের দিনক্ষণ বার করতে হবে! এত ট্রেন, প্লেন বাতিল করাটাই কি আদৌ বিবেচনার কাজ হয়েছে? মনোরোগ চিকিৎসক রিমা মুখোপাধ্যায় হাসছেন, “এ এক অদ্ভুত মানসিক প্রবণতা! এত ক্ষণ সবাই একটা আশঙ্কার মধ্যে ছিলাম। সেই আশঙ্কা ব্যর্থ হওয়ায় তো খুশি হওয়ারই কথা ছিল। তার বদলে আমরা তাৎক্ষণিক কিছু সমস্যা নিয়ে পড়লাম।”
ঝড় না হওয়ার এই ‘হতাশা’ও আজকের সমাজমাধ্যমে ‘কনটেন্ট’ বা ‘বিষয়’ হয়ে উঠেছে। ‘দানা’ হানা দেওয়ার আগে থেকে রাতভর নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সজাগ উপস্থিতি ঘিরেও নানা মত ছিটকে আসছে। শাসকদলের অনুগামীরা স্বভাবতই মুখ্যমন্ত্রীর অতন্দ্র তৎপরতা নিয়ে মুখর। আবার কেউ কেউ আঙুল তুলছেন, আর জি কর-কাণ্ডের পরে দানার আবহে উনি তাঁর ভাবমূর্তি উদ্ধারের সুযোগ পেলেন! সময়ের ফেরে জনমানসের ক্ষোভ বা হতাশারও একটা আশ্চর্য রাজনীতিকরণ হচ্ছে বলে মনে করেন অর্থনীতির প্রবীণ অধ্যাপক সৌরীন ভট্টাচার্য। তিনি বলছেন, “নবান্নে জুনিয়র ডাক্তারদের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর বৈঠকের পরে পরিচিতদের বেশ কিছু ফোন পেয়েছিলাম। আবার দানার ঝোড়ো মেজাজের পরেও পাচ্ছি। অদ্ভুত ভাবে দেখছি, অনেকের মধ্যেই একটা হতাশার সুর প্রকট।” সৌরীনের অভিমত, “ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, দু’টি ক্ষেত্রেই হতাশ হওয়ার কিছু ঘটেনি। মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে ডাক্তারদের বৈঠকে কিছু অপ্রাপ্তি থাকলেও, রাজ্যে, দেশে বা এই উপমহাদেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রকাশ হিসাবে এক সঙ্গে বসা, মত বিনিময় এ সব খুব জরুরি। তাই প্রাপ্তির ভাগও রয়েছে। আর ঘূর্ণিঝড়ের দাপটে শুধু বৃষ্টির ভোগান্তি কপালে জুটল, এ তো সত্যিই শান্তির ব্যাপার!”
ঝড়হীন শহরে বৃহস্পতিবার রাত ২টোতেও কিন্তু দেখা গিয়েছে পার্ক সার্কাস মোড়ে বিরিয়ানির দোকানের সামনে অপেক্ষমান অনলাইন খাবার সরবরাহকারী। পাশের চায়ের ঠেক, মুরগিভাজা, চাউমিনের দোকান সরগরম। এর মধ্যেও অনেকটা বিপদ মাথায় পুরীতে ঝড় দেখতে যাওয়ার মানসিকতা খুঁজে পাচ্ছেন রিমা। আর সৌরীনের উপলব্ধি, “হয়তো জীবন নিয়ে চারপাশের অনেকেই খুব ক্লান্ত, ধ্বস্ত। অনেকের মধ্যেই একটা গভীর অসন্তোষ। তাই আমরা গণআন্দোলনের বৈঠক থেকে শুরু করে বিপজ্জনক ঝড়েও উত্তেজনার খোরাক খুঁজি। নিজের জীবনেই হন্যে হয়ে কিছু একটা মাদকতা পাওয়ার তাড়না।” রিমার কথায়, “এমনও খেয়াল করেছি, দানার ঝড় তেমন জোরালো না হওয়ায় অনেকেই এক ধরনের চক্রান্তের ছাপ দেখছেন! যেন, রাজ্যে এখন যা আন্দোলনের মেজাজ চলছিল, ইচ্ছা করে তার থেকে সবার মনটা ঘুরিয়ে দিতেই দানা হাজির হয়েছে।”
‘দানা’র সৌজন্যে এ বার সমাজমাধ্যমের রসিকতাতেও কিছু নয়া সংযোজন চোখে পড়ছে। ওড়িশা থেকে মেদিনীপুর, দক্ষিণ ২৪ পরগনা হয়ে কলকাতায় ঢুকে কমজোরি হয়ে বর্ধমানে প্রবেশ করলে কি তাকে মিহিদানা বলা যাবে? তবু ‘দানা’ সত্যিই মিহি হওয়ায় স্বস্তি ছাপিয়ে আক্ষেপের সুরটাই প্রকট।