বাজেয়াপ্ত হওয়া বাজি। ফাইল চিত্র।
বাজি বিস্ফোরণে মৃত্যুর ঘটনা ঘটলেই আলোচনা শুরু হয় বাজি কারখানার ‘ক্লাস্টার’ (এক জায়গাভুক্ত) তৈরির ব্যাপারে। ভুক্তভোগীদের দাবি, এত দিন এই আলোচনা চলত স্থানীয় নেতা-দাদাদের বৃত্তে বা নিজেরাই বেআইনি বাজি কারবারে জড়িত রয়েছেন, এমন প্রভাবশালীদের মধ্যে। কিন্তু এগরা, বজবজ, মহেশতলার মতো পর পর ঘটনার প্রেক্ষিতে এই প্রথম ক্লাস্টার করে দেওয়া নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে প্রশাসনের শীর্ষ স্তরে। সেটি ইতিবাচক হিসাবে দেখলেও অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, প্রশাসন আগেই কেন সক্রিয় হল না? পুলিশি সক্রিয়তার অভাবের কথা মনে করিয়ে তাঁদের আরও প্রশ্ন, ক্লাস্টার হলেও পর্যাপ্ত নজরদারি থাকবে তো? না কি বৈধ উপায়ে তৈরি হবে সেই জতুগৃহই!
‘পশ্চিমবঙ্গ বাজি শিল্প উন্নয়ন সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক শুভঙ্কর মান্নার দাবি, ‘‘সবুজ বাজিই যে বিকল্প, সেটা জানিয়ে এবং ক্লাস্টার তৈরির আবেদন নিয়ে গত ছ’মাসে একাধিক চিঠি পাঠানো হয়েছে নবান্নে, মুখ্যমন্ত্রীর দফতরে। প্রমাণ-সহ দেখাতে পারি, কোনওটিরই উত্তর আসেনি। সরকার আগে সক্রিয় হলে অনেক মৃত্যুই আটকানো যেত।’’ বাজি ব্যবসায়ীদের সংগঠনগুলির বড় অংশেরই দাবি, সরকারি সাহায্য না পেয়েই বহু বাজি ব্যবসায়ী বেআইনি কারবারে ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু শুধুমাত্র এই কারণে কি বেআইনি বাজি তৈরির এমন মারণ-ব্যবসার অপরাধ লঘু করে দেখানো যায়? মহেশতলা, বজবজের বাজি ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘প্রদেশ আতশবাজি ব্যবসায়ী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক শুকদেব নস্করের দাবি, ‘‘কিছু ব্যবসায়ীর দোষ তো আছেই। তবে সরকারের গাফিলতি আরও বেশি। আমাদের সঙ্গে থাকা প্রায় ১০০টি বাজি ইউনিটের মালিক সবুজ বাজি তৈরি শিখতে চান বলে সরকারের দোরে দোরে ঘুরছেন। কিন্তু কাজের কাজ হচ্ছে না।’’
শুকদেব জানান, এককালীন ১৫ কেজি পর্যন্ত বাজি ও বাজির মশলা তৈরির লাইসেন্স নিতে হয় জেলাশাসকের কাছ থেকে। এককালীন ১৫ থেকে ৫০০ কেজি হলে ‘কন্ট্রোলার অব এক্সপ্লোসিভস’-এর কাছ থেকে লাইসেন্স নেওয়ার নিয়ম। তারও বেশি ওজনের বাজির ব্যবসার ক্ষেত্রে লাইসেন্স দেন ‘চিফ কন্ট্রোলার’। ১৫ কেজি পর্যন্ত সবুজ বাজির কাজ করতে চেয়ে জেলাশাসকের কাছে আবেদন করেছিলেন ওই ১০০ জন ব্যবসায়ী। তাঁদের দাবি, সেখান থেকে বলা হয়, ‘ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট’ (নিরি)-এর ছাড়পত্র ছাড়া কিছুই করা যাবে না। ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, লোকালয়ের বাইরে তাঁদের নিজস্ব কয়েক বিঘা জমি রয়েছে। সবুজ বাজি তৈরির কাজ শিখে তাঁরা সেখানেই ক্লাস্টার করে বৈধ বাজি তৈরি করবেন। কিন্তু তাঁদের কথা শোনাই হয়নি বলে অভিযোগ! এর পরে তাঁরা নিরি-র দফতরে আবেদন করেন। সেখান থেকেও বলা হয়, জেলাশাসকের অনুমতি ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। এর পরে আরও কয়েক বার চিঠি পাঠানোর পরে নিরি জানায়, তারা প্রশিক্ষণ দিতে প্রস্তুত। কিন্তু এ জন্য রাজ্যের ‘মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ়েস অ্যান্ড টেক্সটাইলস’ (এমএসএমই) দফতর থেকে লিখিত অনুরোধ পাঠাতে হবে। তার পরে নিরি প্রশিক্ষণ দেবে ও তার ভিত্তিতে পাওয়া যাবে শিক্ষানবিশ শংসাপত্র। তখন জেলাশাসকের দফতর থেকে ছাড়পত্র নিয়ে নিরি-র কাছে আবেদন করলে সব দিক খতিয়ে দেখে মিলবে পাকা শংসাপত্র। কিন্তু এমএসএমই এই ব্যবসায়ীদের হয়ে আদৌ আবেদন করবে কি না বা শিক্ষানবিশ শংসাপত্র দেখে জেলাশাসকের দফতর কাজ এগোবে কি না, তা নিয়েই সংশয় ছিল। যদিও মঙ্গলবার নবান্নে ঠিক হয়েছে, এই ধরনের শংসাপত্রের জন্য এক জানলা ব্যবস্থা করার বিষয়ে জোর দেওয়া হবে।
অভিযোগ, এখন বেআইনি বাজির কারবারে যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে কাঠকয়লা, সালফার, অ্যালুমিনিয়াম পারক্লোরেট বা বেরিয়াম নাইট্রেট। যেমন খুশি ব্যবহার বন্ধ হচ্ছে না পটাশিয়াম নাইট্রেটের মতো রাসায়নিক এবং আর্সেনিক বা সীসার মতো ভারী ধাতুরও। পরিবেশ বিজ্ঞানী স্বাতী নন্দী চক্রবর্তী বললেন, ‘‘আতশবাজিতে লোহা বা ইস্পাত পাউডারের মতো ধাতু থাকে। এ ছাড়াও, থাকে অ্যালুমিনিয়াম, দস্তা বা ম্যাগনেসিয়ামের ধূলিকণা। যাতে উজ্জ্বল আলো তৈরি হয়। এর সবই নিষিদ্ধ হলেও ব্যবহার আটকানো যাচ্ছে না। সরকারকেই এ ব্যাপারে সক্রিয় হতে হবে। সেই সঙ্গেই চাই ক্লাস্টার তৈরি করে নিয়মভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে কড়া নজরদারি।’’
কিন্তু ক্লাস্টার হলেও কড়া নজরদারি হবে তো? রয়েই যাচ্ছে সংশয়।