শিয়ালদহ আদালতের ২১০ নম্বর ঘরের বাইরে সাজা ঘোষণা শুনতে ভিড়। ছবি: দেবস্মিতা ভট্টাচার্য।
২১০ নম্বর ঘর।
সোমবার দিনভর আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিল শিয়ালদহ আদালতের এই কোর্টরুম।
শিয়ালদহ কোর্টের ওই ঘরে তখন অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা বিচারক অনির্বাণ দাস বক্তব্য শুনছেন আর জি কর-কাণ্ডে দোষী সাব্যস্ত সঞ্জয় রায়ের। এজলাসে তখন ঠাসাঠাসি ভিড়। যাঁরা এজলাসে ঢুকতে পারেননি— সেই সব আইনজীবী, সাধারণ মানুষ, কোর্টের কর্মীদের ভিড়ে তিল ধারণের জায়গা নেই ঘরের সামনে। অনেকেই এসেছেন সঞ্জয়কে একটি বার চোখের দেখা দেখতে। কলকাতা পুলিশের সিভিক ভলান্টিয়ার সঞ্জয়ের শাস্তি জানতে নিজের মামলা ছেড়ে ওই ঘরের সামনে উঁকিঝুঁকি মারছেন অনেক বিচারপ্রার্থীও! ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুহাস দাস নামে এক যুবক লাফিয়ে লাফিয়ে এজলাসের ভিতরে কিছু দেখার চেষ্টা করছিলেন। কী দেখছেন? জবাব এল— “সঞ্জয়কে দেখার চেষ্টা করছি।”
শিয়ালদহ আদালতের বাইরে এ দিনও ছিল পুলিশের ত্রিস্তরীয় সুরক্ষা বলয়। তার বাইরে দাঁড়িয়ে ছিল পুলিশের একাধিক গাড়ি, বিশাল বাহিনী। এ দিন আদালত চত্বরে জড়ো হন বহু মানুষ ও বিক্ষোভকারী। তাঁদের সামলাতেই গার্ডরেল দিয়ে আদালতের সামনের রাস্তা ঘিরে ফেলে পুলিশ। সেখানে দাঁড়িয়ে পোস্টার হাতে বিক্ষোভরত বিধাননগরের নবারুণ ভট্টাচার্য বললেন, ‘‘একটা পচে যাওয়া সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্র ব্যবস্থাতেই এমন নৃশংস ঘটনা ঘটতে পারে।’’ পরে পুলিশ এসে তাঁকে সরিয়ে নিয়ে যায়।
এ দিন শিয়ালদহ মেট্রো স্টেশনের সামনে বিক্ষোভ দেখায় ‘অভয়া মঞ্চ’। স্লোগান ওঠে— ‘সঞ্জয় একা দোষী নয়, বাদবাকিরা গেল কই?’, ‘সেটিং আমরা ভেঙে দেব, বিচার আমরা ছিনিয়ে নেব’। আন্দোলনরত বজবজ সন্তোষপুরের বাসিন্দা শম্পা দত্ত বলেন, ‘‘সঞ্জয়ের ফাঁসি চাই। যাতে এই ধরনের অপরাধীদের কাছে কড়া বার্তা যায়।’’ যাদবপুরের আভা মাইতি বলেন, ‘‘শুধু ফাঁসি দিলে হবে না। এই ধরনের অপরাধ ঠেকাতে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তন দরকার।’’ মুরারিপুকুরের বাসিন্দা বিশ্বজিৎ বসাকের দাবি, ‘‘এই ঘটনার পিছনে আরও অনেক বড় মাথা রয়েছে।’’ অফিসের কাজে বেরিয়েও আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন সরকারি ব্যাঙ্কের কর্মী, দমদম ক্যান্টনমেন্টের দিব্যেন্দু চন্দ। বললেন, ‘‘যে দোষী, তার ফাঁসি হওয়া উচিত। সঞ্জয় একা এই কাজ করেছে কিনা, সন্দেহ আছে। ফাঁসি হলে এই ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে বার্তা যাবে। তবে শুধু ফাঁসি দিলে এমন অপরাধ কমবে না। সরকারকে ইতিবাচক পদক্ষেপ করতে হবে।’’
এর মধ্যেই সকাল ১০টা ৪০ মিনিট নাগাদ আদালতে আনা হয় সঞ্জয়কে। কোর্ট লক-আপ থেকে পাশের ২১১ নম্বর ঘরের মধ্যে দিয়ে গ্রিন করিডর করে সাড়ে ১২টা নাগাদ ২১০ নম্বর ঘরে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তখন ঘরের বাইরে শোরগোল পড়ে যায়। সঞ্জয়কে দেখতে ধাক্কাধাক্কি শুরু হয়। অনেকেই মোবাইলে ছবি, নিজস্বী তুলতে থাকেন। ভিড়ের মধ্যে ছেলে চন্দ্রনাথ গড়াইয়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিলেন বাগুইআটি হাতিয়াড়ার ভারতী গড়াই। অন্য একটি মামলার সূত্রে এ দিন কোর্টে এসেছিলেন মা-ছেলে। পায়ে পায়ে চলে এসেছেন ২১০ নম্বর ঘরের সামনে। বললেন, ‘‘দোষ করলে সাজা পেতেই হবে। সঞ্জয়ের মৃত্যুদণ্ড চাই।’’
দুপুর ১টা ১৫ মিনিট নাগাদ সঞ্জয়কে এজলাস থেকে নিয়ে যাওয়ার পরে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। আড়াইটে নাগাদ ফের দরজা খুললে ভিতরে ঢুকতে হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। আইনজীবী সুবীরকুমার রাউত বলেন, ‘‘সঞ্জয়কে দেখতে এমন উৎসাহ অবাক করার মতো।’’ আর এক আইনজীবী কাজল দাস বলেন, ‘‘শিয়ালদহ কোর্টে এমন দৃশ্য আগে দেখিনি। এটা নজিরবিহীন।’’ আদালত সূত্রের খবর, ভিড়ের চাপে ২১০ নম্বর ঘরের দরজার একটি পাল্লার বিম খুলে যায়।
তবে সঞ্জয়ের সাজা শুনে ক্ষুব্ধ কোর্টে উপস্থিত সাধারণ মানুষ থেকে আন্দোলনকারীরা। সেই খবর আসতেই আন্দোলনকারীদের স্লোগান তীব্রতর হয়। বারাসতের নিমাই ঘোষ বলেন, ‘‘এই রায়ে হতাশ। ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল।’’ আন্দোলনরত শেফালি ঘোষ বলেন, ‘‘এটা বিচারের নামে প্রহসন ছাড়া কিছু নয়।’’ বাইরে তখন স্লোগান— ‘কলকাতা পুলিশ ধিক্কার, সিবিআই ধিক্কার’।