কলকাতার বন্ধুদের সঙ্গে কেনিয়ার পড়ুয়ারা। —নিজস্ব চিত্র
‘‘বাংলা ভাষা মিষ্টি! কিন্তু আপনারা যখন দ্রুত বলে যান, কিছুই শিখতে পারব বলে মনে হয় না’’— বলছিলেন পিটার মুতুরি, নাইরোবির কাম্বিমোতো কমিউনিটির সদস্য। সল্টলেকের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে কলকাতায় এসেছেন চার মাসের জন্য। সঙ্গে তাঁর চার-পাঁচ জন বন্ধু। ওঁরা বাংলা শিখবেন, এ শহরকে চিনবেন আর চেনাবেন নাইরোবিকে।
পিটার, জ়াইনাব কিলোনজ়ো, ওবি ওবিসা, কামিলা গোজোবে, জেমস ওয়ামেদের ঐতিহ্য অনুযায়ী, তাড়াতাড়ি কথা বলা মানে অন্যকে অসম্মান করা। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য মিলি রায় বলেন, ‘‘মাটিতে বসে কিছু করা বা বলাও ওঁদের প্রথা বিরোধী’’। ‘স্টুডেন্ট এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রাম’-এর সুবাদে পিটাররা এখন কলকাতায়। আগে কলকাতা থেকে মিলি ছাড়াও মনীশ চৌধুরী, প্রিয়া সূত্রধর, গোপাল রায়েরা ঘুরে এসেছেন কেনিয়া থেকে।
ফেব্রুয়ারি কৃষ্ণাঙ্গদের ইতিহাসের মাস (ব্ল্যাক হিস্ট্রি মান্থ)। পিটারেরা চান, কৃষ্ণাঙ্গদের সংগ্রামের কথা মানুষ বেশি করে জানুন। ভ্রান্ত ধারণা দূর হোক। নাইরোবির যে অংশে এই ছেলেমেয়েরা থাকেন, সেখানে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য খুঁজে পাওয়া ভার। প্রথা মেনে ১১-১২ বছর বয়স হলেই ছেলেরা পরিবার থেকে দূরে সরে যায়। মেয়েরাও যায়। তবে বাঁধাধরা নিয়ম নেই। সেই বয়স থেকেই লড়াইয়ের শুরু। ঘিঞ্জি ঘরে শৌচাগার, পানীয় জলের সুবিধাটুকুও ঠিক মতো মেলে না। পেটের দায়ে করতে হয় এমনও কিছু কাজ, যা সমাজের চোখে সম্মানজনক নয়। এ ভাবেই বড় হচ্ছিলেন পিটাররা। তখনই ‘মুঙ্গানো’ নামে একটি গোষ্ঠীর হাত ধরে তাঁদের অন্য রকম বেঁচে থাকার শুরু।
এই গোষ্ঠীর সাহায্যে ওঁরা নিজেদের সমস্যাগুলো স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরি করে বাসিন্দাদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে শুরু করেন। এখন সচেতনতা বাড়াতে ব্যবহার হচ্ছে সেগুলি। প্রশাসনও বিভিন্ন পদক্ষেপ করছে। ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে অম্লানকুসুম গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘‘ওঁরা প্রশাসনকে অসুবিধার কথা জানিয়েছেন এই সব ছবির মাধ্যমে। তবে পুলিশ চটে যায়, এমন কোনও কথা ওঁরা বলবেন না। ওখানে ‘শুট অ্যাট সাইট’ কোনও ব্যাপার নয়। কে কী করল, না জেনেই মেরে দিতে পারে পুলিশ।’’
জেমস বলেন, ‘‘এখন ওখানে মেয়েদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাস চালানো থেকে কন্ডাক্টর—সব রকম কাজেই এগিয়ে মেয়েরা। কন্যাসন্তান হলে সেটা আনন্দের। তার জন্য আমরা একটু কোণঠাসা!’’ শুনে হেসে ওঠেন মেয়েরা। ছেলেরা ১১-১২ বয়সে বাবা-মায়ের কাছ থেকে না চলে গেলে তারা ঠিক ‘পুরুষ’-এর গোত্রে পড়ে না। ২৫-এর মধ্যে বিয়ে করে সেই পুরুষকে পরিবারের দায়িত্ব নিতেই হবে। মেয়েদের ক্ষেত্রে বরং রাশটা অনেক আলগা।
কামিলা সরস্বতী পুজোয় শাড়ি পরেছেন। ‘‘শাড়ি পরা কি সহজ নাকি!’’— হেসে গড়িয়ে পড়েন কামিলা। জ়াইনাব আবার বলেন, ‘‘কী লম্বা তোমাদের শাড়ি। গোটাটা জড়িয়ে পরতে হবে। চ্যালেঞ্জিং!’’ দেশে ফিরে কামিলারা অন্যদেরও শেখাতে চান শাড়ি পরা। জেমস পরেছেন কুর্তা পাজামা। ভারতীয় সংস্কৃতি, খাবার তাঁদের পছন্দ হয়েছে। তবে কামিলা বলেন, ‘‘তোমরা এত মশলা খাও! কিন্তু এখন খেতে খেতে সয়ে গিয়েছে। কেনিয়ায় এত মশলা খাই না আমরা।’’ ওবি জানান, ওঁদের মূল খাবার উগালি। ‘‘ভুট্টার আটা গরম জলে মিশিয়ে নাড়তে থাকা, সেটা জমে এলে আনাজ দিয়ে খাওয়া’’— বোঝন মিলি। ওঁরা সঙ্গে এনেছেন ২০ কিলোগ্রাম উগালি!
নাইরোবি গিয়ে অনেক পর্যটক নানা অসুবিধার মুখে পড়েন। লুটপাট, হুমকি তো লেগেই থাকে। কেন এমনটা হয়? পিটার ভরসা দিয়ে বলেন, ‘‘আমরা পর্যটকদের ভালবাসি। আশপাশের সোমালিরা কিছু ঝামেলা করে ঠিকই। তার জন্য কেনিয়ার দুর্নাম হয়। আমার সঙ্গে কেনিয়া ঘুরবেন, কেউ কিছু করতে পারবে না।’’