উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটা থেকে নিয়ে আসা হয়েছিল কিডনির অসুখে আক্রান্ত শাহিদ মণ্ডলকে। কিন্তু, চিকিৎসক না থাকার কারণে ফিরে যেতে হয় তাকে। সোমবার, এসএসকেএমে। ছবি: দীপঙ্কর মজুমদার।
আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসক-ছাত্রীকে ধর্ষণ ও খুনের ঘটনায় শহরের অন্য মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতেও কর্মবিরতি শুরু করেছেন চিকিৎসক-পড়ুয়ারা। যার জেরে সপ্তাহের প্রথম দিন, সোমবার দিনভর চিকিৎসা পরিষেবা অনেকটাই ব্যাহত হল। এমনকি, জরুরি বিভাগেও পর্যাপ্ত চিকিৎসক না থাকায় রোগীদের অনেকে ফিরে যেতে বাধ্য হন বলে অভিযোগ।
তবে আর জি করের ঘটনার প্রতিবাদে এ দিন ‘ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’-এর রাজ্য শাখা এবং ‘দ্য জয়েন্ট প্ল্যাটফর্ম অব ডক্টর্স’ যৌথ সাংবাদিক বৈঠকের ডাক দিয়েছিল। সেখানে সমস্ত মেডিক্যাল কলেজের আবাসিক চিকিৎসকদের আন্দোলনকে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি তাঁদের জরুরি পরিষেবায় কর্মবিরতি না করার অনুরোধ করা হয়। কারণ, লড়াইটা সাধারণ মানুষের সঙ্গে নয়। তাই অসুস্থ মানুষেরা যাতে জরুরি পরিষেবা পান, সে দিকে নজর রাখার আবেদন করেন দুই সংগঠনের সিনিয়র চিকিৎসকেরা।
আর জি কর হাসপাতালে এ দিন সকালে বহির্বিভাগের টিকিট দেওয়া শুরু হলেও চিকিৎসকদের দেখা মেলেনি বলে অভিযোগ। অস্থি বিভাগের বহির্বিভাগে এক চিকিৎসকের দেখা মিলেছিল। কিন্তু কিছু ক্ষণের মধ্যেই তাঁকে বিভাগ থেকে বার করে দেন আন্দোলনকারীরা। বিশাখা খান নামে হাওড়ার কদমতলার এক বাসিন্দার অভিযোগ, ‘‘হাত ভেঙেছে। এখানে প্লাস্টার করিয়েছি। আমার সামনেই ওই চিকিৎসককে বার করে দেওয়া হল।’’ সুধীর বিশ্বাস নামে উত্তরপাড়ার এক বাসিন্দার স্ট্রোক হয়েছিল রবিবার। তাঁকে স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি করে পরিবার। অভিযোগ, সেখানে এমন ভাবে ক্যাথিটার লাগানো হয় যে, তাঁর প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। সেই অবস্থায় এ দিন আর জি করে আনা হলেও দিনভর তাঁর চিকিৎসা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছে। স্নায়ুর রোগে আক্রান্ত, দেগঙ্গার পার্বতী কর্মকার নামে এক রোগীকে কাঁধে চাপিয়ে আর জি করের জরুরি বিভাগ থেকে বার করে বাঙুর নিউরোসায়েন্সেসের দিকে রওনা দেন তাঁর পরিজনেরা।
দুপুরে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে রেডিয়োথেরাপি নিতে এসেছিলেন মুর্শিদাবাদের হরিহরপাড়ার বাসিন্দা, ক্যানসার আক্রান্ত আয়েজান বিবি। এ দিনই তাঁর রেডিয়োথেরাপির প্রথম দিন ছিল। আয়েজানের কথায়, ‘‘ডাক্তার নেই। সপ্তাহ দুয়েক পরে আসতে বলা হয়েছে।’’ বর্ধমানের রায়নার বাসিন্দা, ফুসফুসের ক্যানসারে আক্রান্ত শেখ শাহমত আলির স্ত্রী ছবি বিবি জানান, গাড়ি ভাড়া করে বর্ধমান থেকে এসেছিলেন। কিন্তু হাসপাতালে কোনও ডাক্তার নেই বলে তাঁদের ফিরে যেতে হচ্ছে।
প্রায় একই ছবি এসএসকেএম হাসপাতালে। অন্তঃসত্ত্বা মুর্শিদা খাতুনের পরিজনদের অভিযোগ, চিকিৎসক না থাকায় মুর্শিদাকে শহরের অন্য নার্সিংহোমে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। উত্তর ২৪ পরগনার গাইঘাটার বাসিন্দা, বছর ছয়েকের শাহিদ মণ্ডল দীর্ঘদিন ধরে কিডনির অসুখে আক্রান্ত। অভিযোগ, চিকিৎসক না থাকায় তাকে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতে হয় পরিজনদের।
রোগী-পরিষেবার প্রায় একই রকম দুর্দশার ছবি দেখা গেল কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। সেখানে নাজিবুল মোল্লা নামে এক রোগীর পরিজনের অভিযোগ, দু’জন অন্তঃসত্ত্বা মহিলাকে ভর্তি নিতে দেরি করা হয়। শান্তনু দাস নামে এক রোগীর আত্মীয়ের অভিযোগ, চিকিৎসক না থাকায় এ দিনও তাঁর স্ত্রীর টিউমারের অস্ত্রোপচার করা হয়নি। লিলুয়ার বাসিন্দা রাজকুমার সিংহের অভিযোগ, তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী স্বপ্না সিংহকে প্রথমে প্রসূতি বিভাগের গেটের সামনে আটকে দেওয়া হয়। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তাঁর স্ত্রীকে ভর্তি নেওয়া হয়েছে।
অন্য দিকে, এ দিন সকাল থেকে হাসপাতাল চত্বরে আন্দোলনরত চিকিৎসকেরা তারস্বরে মাইক বাজিয়ে সুবিচারের দাবি তোলেন। আর জি কর হাসপাতালের উল্টো দিকের রাস্তায় এসএফআই, ডিওয়াইএফআই এবং সিপিএমের মহিলা সংগঠনও তারস্বরে মাইক বাজিয়ে একই দাবি তোলে। আন্দোলনের নামে দিনভর হাসপাতাল চত্বরে এ ভাবে মাইক বাজানো হল কেন, সেই প্রশ্ন উঠেছে। এই প্রসঙ্গে সিপিএম নেত্রী মীনাক্ষী মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘এটা ঠিক নয়। তবে এই পরিস্থিতিতে চোঙা না বেঁধে উপায় ছিল না।’’ বিকেলে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়ারাও সুবিচারের দাবিতে স্লোগানের দিতে দিতে আর জি কর চত্বরে বিক্ষোভ করেন।