হাসপাতালে শিপ্রাদেবী। শুক্রবার। — নিজস্ব চিত্র
পরপর দু’বার লোহার ভারী ডান্ডার আঘাত মাথায়। তিন বারের বার মারতেই মাথার পিছনে হাত ঘুরিয়ে কোনও রকমে ডান্ডাটা ধরে ফেলেছিলেন শিপ্রা। হামাগুড়ি দিয়ে কোনও রকমে হাসপাতালের রিসেপশন অবধি পৌঁছে পুরো ঘটনা জানিয়ে জ্ঞান হারান তিনি। কোনও চোর-দুষ্কৃতীকে নিরস্ত্র করার ঘটনা নয়, ডেঙ্গি রোগীর হাতে মার খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি নার্স শিপ্রা মণ্ডল। মাথায় ১৮টি সেলাই। মল্লিকবাজারের হাসপাতালে অন্য দুই নার্স মার্গারেট মণ্ডল এবং ভিক্টোরিয়া থকচমের অবস্থা এখনও সঙ্কটজনক।
বৃহস্পতিবার ভোরে গড়িয়াহাট থানা এলাকার গড়চা রোডের বেসরকারি হাসপাতালে এই ঘটনার পরেই অভিযুক্ত রোগী সুবীর সাহাকে নিয়ে বর্ধমান চলে যান তাঁর আত্মীয়েরা। আনন্দবাজার সুবীরবাবুর আত্মীয়দের সঙ্গে বৃহস্পতিবার এবং শুক্রবার কয়েক দফা কথাও বলেছে। অথচ ঘটনার ৩৬ ঘণ্টা পরে এ দিন সন্ধ্যাতেও পুলিশের দাবি, তারা সুবীরবাবুর হদিস পায়নি। কথা বলা যায়নি তাঁর আত্মীয়দের সঙ্গেও। পুলিশের এই ভূমিকায় যারপরনাই ক্ষুব্ধ গড়চা রোডের হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসাধীন নার্সদের পরিবার।
এটা কি কলকাতা পুলিশের ব্যর্থতা নয়? কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দাপ্রধান বিশাল গর্গ বলেন, ‘‘আপনারা আপনাদের কাজ করুন। পুলিশকে পুলিশের কাজ করতে দিন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘অভিযুক্তদের খোঁজে তল্লাশি চলছে।’’ বর্ধমান ও হাওড়ার পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে কি? গোয়েন্দাপ্রধানের জবাব, ‘‘তদন্তের স্বার্থে এখন কিছু বলব না।’’
অভিযুক্ত রোগীর আত্মীয় প্রবীর সাহার ফোনে এ দিন যোগাযোগ করা হলে এক মহিলা কণ্ঠ জানান, ‘‘সুবীরকে আমরা কোনও হাসপাতালে ভর্তি করতে পারিনি। এক বাড়িতে রেখে চিকিৎসা হচ্ছে। ওর অবস্থার কিছুটা উন্নতিও হয়েছে। তবে ও খুব ভয় পেয়ে গিয়েছে।’’ এর পরেই ওই মহিলা বলেন, ‘‘বারবার আমাদের বিরক্ত করবেন না। রোগী ভাল হয়ে গেলে আমরাই যোগাযোগ করব।’’
গড়চা রোডের হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে এ দিন বৃহস্পতিবারের ঘটনার বিবরণ দিচ্ছিলেন আহত নার্স শিপ্রা মণ্ডল। তিনি জানান, অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় রোগীকে আইসিসিইউতে রাখেন চিকিৎসকেরা। ভোর ৪টে নাগাদ সেখানকার টেবিলে মাথা নিচু করে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন ওই নার্স। আচমকাই খেয়াল করেন, স্যালাইনের স্ট্যান্ড নিয়ে মারমুখী হয়ে তেড়ে আসছেন সুবীরবাবু। ওই ভারী ডান্ডাটি তাঁর মাথায় বসিয়ে দেন ওই রোগী। ‘‘দু’বার বাড়ি খেয়ে কোনও মতে রডটা ধরে ফেলি। আমার মাথা ফেটে তখন গলগলিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। বেরিয়ে এসেছে মাংস,’’ আতঙ্ক জড়ানো গলায় বলছিলেন শিপ্রা। আরও জানান, বাকি দুই নার্স মার্গারেট এবং ভিক্টোরিয়াকে অচৈতন্য অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে তিনিই রক্তাক্ত অবস্থায় কোনও রকমে হামাগুড়ি দিয়ে হাসপাতালের রিসেপশনে পৌঁছে সবাইকে হামলার খবর দেন। রোগীকে নিরস্ত করতে
গিয়ে তাঁর হাতে ঢুকে গিয়েছিল স্যালাইনের হুক। অপারেশন করে তা বার করতে হয়েছে।
ঘটনার রাতে আড়াইটে নাগাদ রোগী মনিটর মেশিনের সব তার খুলে দেন। তখনও শিপ্রাদেবীই তা ফের ঠিকঠাক করে দিয়েছিলেন। সেই রোগীই পরে এমন আচরণ করায় হতভম্ব ওই নার্স। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা লোক দেখলে বুঝতে পারি, কে কী রকম। কিন্তু ওঁর যে এমন কোনও সমস্যা রয়েছে, তা ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। এমনকী আমাদের সঙ্গে কোনও কথা কাটাকাটিও হয়নি।’’ ওই রোগীকে পুলিশ এখনও গ্রেফতার করতে না পারায় আতঙ্ক আরও বেড়েছে শিপ্রাদেবীর। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘হাসপাতালের সিসিটিভির ফুটেজ দেওয়া হয়েছে পুলিশকে। হাসপাতাল থেকেই মিলেছে রোগীর ঠিকানাও। তবু কেন এখনও অভিযুক্তকে আটক করতে পারেনি পুলিশ? কেনই বা যে আত্মীয় পরিজনদের সঙ্গে হাসপাতালে এসেছিলেন সুবীরবাবু, তাঁদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হল না?’’ একই প্রশ্ন মল্লিকবাজারের হাসপাতালে আইসিসিইউ-তে চিকিৎসাধীন অন্য দুই নার্সের আত্মীয়-বন্ধুদেরও। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ভিক্টোরিয়ার মস্তিষ্কে একাধিক অস্ত্রোপচার হয়েছে। ভিক্টোরিয়া ও মার্গারেট দু’জনই
রয়েছেন ভেন্টিলেশনে।
সুবীরবাবুর এমন হিংস্র আচরণের পিছনে অবশ্য ডেঙ্গি জীবাণুর ভূমিকা দেখছেন চিকিত্সকেরা। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, ডেঙ্গির জীবাণুর কারণে মাথায় অক্সিজেন কমে যায়। তার জেরে এমন আচরণ করতে পারেন রোগী। ডেঙ্গির জীবাণু সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেমকেও আক্রমণ করলে অস্বাভাবিক হিংস্র আচরণ করেন অনেকে। তবে সুবীরবাবুর ক্ষেত্রে তেমনটাই হয়েছিল কি না, তা খতিয়ে দেখতে হবে বলে জানিয়েছেন তাঁরা।