একজোট: পার্ক সার্কাসের ধর্না মঞ্চে। সোমবার। ছবি: শশাঙ্ক মণ্ডল
‘‘এটা তো কোনও সাধারণ মৃত্যু নয়! এ তো শহিদ হওয়া। সামিদা খাতুন শহিদ হয়ে আমাদের মনের জোর আরও বাড়িয়ে দিয়ে গিয়েছেন। জেদটা যেন কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে।’’
সোমবার পার্ক সার্কাসের ধর্না মঞ্চে বসে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে যাচ্ছিলেন ফারহাত ইসলাম। রিপন স্ট্রিটের বাসিন্দা এই গৃহবধূ আন্দোলনের প্রথম দিন থেকে রয়েছেন এখানে। জেদের কথা শুনে এক বাক্যে মাথা নেড়ে সায় দিলেন পাশে বসা মেটিয়াবুরুজ-তপসিয়ার আমরিন বেগম-নুর জাহান-ইয়াসমিন বেগমেরা। সমস্বরে বলছেন, ‘‘জোশ আরও বেড়েছে। শেষ না দেখে ছাড়ছি না।’’
শনিবার পার্ক সার্কাসের ধর্না মঞ্চে বসে থাকতে থাকতেই অসুস্থ বোধ করেছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা, ৫৭ বছরের সামিদা খাতুন। দেশ হারানোর আতঙ্কে অসুস্থ শরীরে আন্দোলন থেকে দূরে থাকতে মন সায় দেয়নি তাঁর। সন্ধ্যার পরে সেখানেই অসুস্থ বোধ করেন তিনি। পরে হাসপাতালে মৃত্যু হয়।
সহযোদ্ধার মৃত্যুতে কি মনোবল কোথাও ধাক্কা খেয়েছে আন্দোলনকারীদের? ছন্দপতন হয়েছে আন্দোলনের? সোমবার বিকেলের পার্ক সার্কাস অবশ্য এর উল্টো কথাই বলছে। সামিদার স্মরণে রবিবার মাইক বন্ধ রাখা হয়েছিল ধর্না মঞ্চে। নীরবতা পালন করে, শ্রদ্ধাঞ্জলি দিয়ে সহযোদ্ধাকে স্মরণ করেছিলেন আন্দোলনকারী মহিলারা। সোমবার সকাল থেকে তাঁরা ফের পুরনো ‘মুডে’। মাইকে নাগাড়ে চলছে স্লোগান-গান-কবিতা পাঠ। পোস্টার-জাতীয় পতাকা হাতে একজোট হয়ে বসে রয়েছেন মহিলারা। জাতীয় পতাকা থেকে কোলের শিশু, দুধের বোতল থেকে এনআরসি-সিএএ বিরোধী পোস্টার— সবই রয়েছে সঙ্গে। ধর্না মঞ্চের এক পাশে ঠিক কোন জায়গায় প্রতিদিন এসে বসতেন সামিদা, তা এক লহমায় দেখিয়ে দিলেন রত্না সাহা রায়। মুসলিম মহিলাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া রত্নাকে বারবার বাংলায় বক্তৃতা দিতে বলতেন সামিদা। রত্না বলছেন, ‘‘না না দেখাব না, কাগজ দেখাব না— বাংলায় এই স্লোগানটা পছন্দ করতেন সামিদা। আমাকে প্রায়ই বলতেন, বাংলায় ওই স্লোগানটা একবার দাও না।’’
হাজার জনের ভিড়ে আলাদা করে সামিদার সঙ্গে বিশেষ আলাপ ছিল না তপসিয়ার আমরিন বেগমের। তবে ২৮ দিন ধরে একসঙ্গে থাকতে থাকতে মুখ চেনা তো হয়েই যায়। সামিদার মৃত্যুতে তাই হতোদ্যম নন, আরও ‘হিম্মত’ বেড়েছে দু’মেয়ের মা আমরিনের। জোর গলায় বলছেন, ‘‘সরকার ভেবেছিল সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনোবল কমবে। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে, ততই আমরা জেগে উঠছি।’’ মধ্যবয়সী মুন্নি বেগম আবার বলছেন, ‘‘আল্লা ছাড়া কেউ কোনও জিনিস এমনি এমনি দেয় না কি! আমরাও লড়াই করে নিজেদের অধিকার ছিনিয়ে নেব।’’
আর ভয়? শাহিন বাগ-জামিয়া মিলিয়ার সামনে গুলি চলেছে দেখেও কি বুক কাঁপছে না? হৃদ্রোগ নিয়ে প্রথম দিন থেকে ঘর-সংসার ফেলে ধর্না মঞ্চেই বসে রয়েছেন নুর জাহান। তাঁর সাফ জবাব, ‘‘মরার ভয় করি না। ভয় থাকলে তো বাড়িতেই বসে থাকতাম। বাড়ি থেকে বেরিয়ে এখানে এসেছি যখন, তখন এটা জেনেই এসেছি যে যা খুশি হতে পারে।’’
নুর জাহানের কথা শুনে ফারহাত বলছেন, ‘‘এত দিন মনে হচ্ছিল কী করে হবে। অথচ এই এক মাসে নিঃসঙ্কোচে উঠে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করতে পারছি। এর জন্য মোদীজিকে অনেক ধন্যবাদ।’’ ধর্না মঞ্চে তখন রোল উঠেছে— ‘হাল্লা বোল’।