এসএসকেএমের নেফ্রোলজি বিভাগের লগবুকে সেই নির্দেশ।
ডায়ালিসিস হবে ‘অন পজিটিভ মেশিন!’
এসএসকেএম হাসপাতালের নেফ্রোলজি বিভাগের লগবুকে এই ভাষাতেই লেখা হয়েছিল ‘কেস’টা। রোগী— ‘আননোন ডগ’। অবশ্য হাসপাতালের সদ্য প্রাক্তন অধিকর্তা প্রদীপ মিত্রকে পাঠানো এসএমএসে নেফ্রোলজির বিভাগীয় প্রধান রাজেন্দ্র পাণ্ডে সেই ‘আননোন’-কেই বলেছেন ‘ভিভিআইপি’।
‘আননোন’ হোক বা ‘ভিভিআইপি’, নেফ্রোলজি বিভাগের লগবুক প্রমাণ করে দিচ্ছে, স্রেফ রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের মন রাখতে খুব ভেবেচিন্তেই এই ‘পজিটিভ মেশিনে’ ডায়ালিসিসের জন্য আনা হচ্ছিল কুকুর-রোগীকে। আর কঠিন রোগে আক্রান্ত মানুষ-রোগীদের জেনেশুনেই ঠেলে দেওয়া হচ্ছিল মৃত্যুর মুখে।
কী এই ‘পজিটিভ মেশিন’?
এসএসকেএমের নেফ্রোলজি বিভাগে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সেখানে শুধুমাত্র এইচআইভি-আক্রান্ত, হেপাটাইটিস-বি ও হেপাটাইটিস-সি আক্রান্ত রোগীদের জন্য একটি ডায়ালিসিস মেশিন আলাদা করে রাখা থাকে। সেটিকেই বলা হয় ‘পজিটিভ মেশিন’। সেই যন্ত্রেই ওই ‘ভিভিআইপি’ কুকুরের ডায়ালিসিস করার কথা হয়েছিল। কিন্তু কেন?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কুকুর বা অন্য কোনও পশু-পাখির ডায়ালিসিস করার পর ওই একই যন্ত্র মানুষের জন্য ব্যবহার করা হলে মারাত্মক রোগ ছড়ানোর আশঙ্কা থাকে। কারণ সে ক্ষেত্রে রক্তের মাধ্যমে পশু-পাখির দেহের ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া মানুষের দেহে সংক্রমিত হতে পারে। এর ফলে অপেক্ষাকৃত সুস্থ মানুষ যদি ডায়ালিসিসের পর-পরই রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েন, তখন কীসের থেকে রোগ হল তা খোঁজার চেষ্টা হবে নিশ্চিত ভাবেই। তাতে কুকুরের ডায়ালিসিসের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার আশঙ্কা।
এবং সেই কারণেই ‘পজিটিভ’ মেশিন ব্যবহারের ছক।
এইচআইভি বা হেপাটাইটিস-বি, বা সি আক্রান্তরা এমনিতেই বহু ধরনের শারীরিক অসুবিধায় ভোগেন। তাঁদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও থাকে খুব কম। বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, ‘পজিটিভ মেশিনে’ ডায়ালিসিসের পর পশুর দেহ থেকে আসা কোনও জীবাণুর জন্য ওই রোগীদের দেহে সমস্যা দেখা দিলে অনায়াসেই সেই অসুস্থতাকে ‘আগে থেকেই ছিল’ বলে চালিয়ে দেওয়া যেত। গুরুতর অসুস্থ হয়ে মানুষটি মারাও গেলেও সকলের চোখে ধুলো দেওয়া যেত সহজে।
যে দিন ওই কুকুরের ডায়ালিসিসের তোড়জোড় চলছিল, সে দিন এসএসকেএমের নেফ্রোলজিতে ডিউটিতে থাকা এক চিকিৎসকও বললেন, ‘‘রোগীর নামের পাশে ‘অন পজিটিভ মেশিন’ লেখার অর্থই হল, ওই আলাদা মেশিনে ডায়ালিসিস করতে হবে।’’ প্রশ্ন হল, এমন মারাত্মক নির্দেশটি দিয়েছিলেন কে?
ওই চিকিৎসকের কথায়, ‘‘রাজেন্দ্র পাণ্ডে স্যার টেলিফোনে আমাদের এক জন ডিএম, পিডিটি (ডক্টর ইন মেডিসিন, পোস্ট-ডক্টরাল ট্রেনি)-কে কুকুরের ডায়ালিসিসের নির্দেশ দিয়েছিলেন। সে বয়স ও অভিজ্ঞতায় অনেক জুনিয়র। এর ফল কী হতে পারে না বুঝেই সে লগবুকে সব লিখে ফেলেছিল। ওই লেখা ফাঁস হয়েই কাল হয়েছে।’’
ওই চিকিৎসক জানিয়েছেন, কুকুরের শারীরিক অবস্থা কেমন, কোন মেশিনে তার ডায়ালিসিস হবে, সেই সময়ে জলের বেগ কেমন হবে, হেপারিন কতটা যাবে, কতটা জল বার করে দেওয়া হবে, কুকুরটিকে
কোথায়, কত ক্ষণ নজরদারিতে রাখা হবে— নেফ্রোলজির বিভাগীয় প্রধান রাজেন্দ্রবাবু সে সবই ওই জুনিয়রকে বিস্তারিত ভাবে বলছিলেন। জুনিয়রটিও লগবুকে তা হুবহু লিখে রেখেছিলেন (যার ছবি আনন্দবাজারের কাছে রয়েছে)।
ডায়ালিসিসের সময় এক জন পশুচিকিৎসককে এসএসকেএমে হাজির থাকতে বলার কথাও লেখা রয়েছে লগবুকে। সেই মতো এক পশুচিকিৎসক ওই দিন কুকুরটিকে আনতেও চলে গিয়েছিলেন। কিন্তু পরিস্থিতি পাল্টে যাওয়ায় মাঝরাস্তা থেকে তিনি ফেরত চলে আসেন। এখন ওই জুনিয়রটি আতঙ্কে কাঁটা হয়ে রয়েছেন বলে নেফ্রোলজি বিভাগ-সূত্রে খবর। কুকুর-কাণ্ড প্রথম প্রকাশ্যে আসার সময় রাজেন্দ্রবাবু বলেছিলেন, সে দিন বিভাগে সব রকম ‘টেকনিক্যাল সাপোর্ট’ তৈরি করে রেখেছিলেন তিনি। এ দিন তাঁকে বহু বার ফোন ও
এসএমএস করেও উত্তর মেলেনি। তবে শনিবার এসএসকেএমের রোগী কল্যাণ সমিতির বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন তিনি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বলছেন, পশু থেকে মানুষে রোগ ছড়ানো বা ‘জুনোটিক ট্রান্সমিশন’-এর নজির অজস্র রয়েছে। ‘কেয়াসানুর ফরেস্ট ডিজিজ’ (কেএসডি) নামে একটি রোগ বাঁদর থেকে ছড়ায়। এ ছাড়া এভিয়েন ফ্লু, ম্যাডকাউ, রেবিস— প্রত্যেকটিরই উৎস কোনও পশু বা পাখি। ভাইরোলজিস্ট নিমাই ভট্টাচার্যের ব্যাখ্যা, ‘‘কিছু ভাইরাস ‘স্পিসিস বেরিয়ার’ (প্রজাতিগত বিভেদ) পার করতেই পারে।
ইবোলা ভাইরাসও শিম্পাঞ্জি থেকে এসেছিল। ফলে সাবধানতা সব সময় রাখা উচিত।’’
এইচআইভি বিশেষজ্ঞ সমীরণ পণ্ডার আশঙ্কা, এই ধরনের সংক্রমণের ফলে পশু ও মানুষের দেহের আরএনএ-তে মিশে একেবারে নতুন ধরনের ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া জন্মালে তার কোনও ওষুধ পাওয়া যাবে না।
তাঁর কথায়, ‘‘এইচআইভি আক্রান্তদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা প্রায় থাকেই না। ফলে তাঁরা বারবার ডায়রিয়া, যক্ষ্মা, ফাঙ্গাল মেনিনজাইটিস ও নানা ধরনের সংক্রমণে আক্রান্ত হন। তার উপর এঁরা পশুর দেহ থেকে আসা কোনও ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়ার মাধ্যমে রোগাক্রান্ত হলে ফল ভয়াবহ হতে পারে।’’ গ্যাসট্রোএন্টেরোলজিস্ট গোপালকৃষ্ণ ঢালিও জানান, হেপাটাইটিস বি বা সি আক্রান্তদের অনেকেরই রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তখন যদি তাঁদের দেহে কোনও পশুর দেহ থেকে ক্ষতিকর ভাইরাস বা ব্যাক্টেরিয়া ঢোকে, তা হলে গুরুতর অসুস্থতার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
সব জেনেশুনেও যাঁরা এমন অবলীলায় রোগীদের প্রাণ বাজি রাখতে পারেন, সেই চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে কেন কোনও ব্যবস্থা নেবে না মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া (এমসিআই)? এমসিআই-এর গ্রিভান্স সেলের চেয়ারম্যান অজয় কুমার বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে অভাবনীয় সব ব্যাপার চলছে। কেউ লিখিত অভিযোগ না-জানালে আমাদের পক্ষে কিছু করাটা সমস্যার। তবু গোটা বিষয়ের উপর আমরা নজর রাখছি। কিছু ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না
সে বিষয়ে আমাদের বৈঠকে বসার কথাও রয়েছে।’’
এসএসকেএমের নেফ্রোলজি বিভাগের এক প্রবীণ চিকিৎসকের আক্ষেপ, ‘‘পশুর থেকেও অসুস্থ মানুষগুলিকে জীবনের দাম কম বলে ধরেছিলেন চিকিৎসকদেরই একাংশ।’’