একাকী: ওষুধ কিনতে নিজেই পথে। বাগুইআটিতে। ছবি: সুমন বল্লভ
কোথাও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাড়িতে পড়ে সাহায্যের আশায় কাতরাচ্ছেন প্রৌঢ়। কোথাও মৃত্যুর ১৫ ঘণ্টা পরেও সাহায্য আসছে না! কোথাও আবার বিনা চিকিৎসায় ঘরে পড়ে থেকেই বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ উঠছে। করোনা অতিমারির এই পরিস্থিতিতে একা বসবাসকারী বৃদ্ধ-বৃদ্ধারাই সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়ছেন বলে অভিযোগ। রোগ হলে তো কথাই নেই, সাধারণ সময়েও তাঁদের খোঁজ নেওয়ার কেউ নেই! অনেক ক্ষেত্রে তাঁদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা ‘কেয়ার গিভারেরা’ও রোজ এসে পৌঁছতে পারছেন না বলে তাঁরা জানাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে অভিযোগ উঠছে কলকাতা পুলিশের ‘প্রণাম’ প্রকল্পের ভূমিকা নিয়েও। বয়স্কদের দাবি, তাদের বার বার ডেকেও সাড়া মিলছে না।
‘কেয়ার গিভার’ এর দেখভালে একাই থাকেন বাগবাজারের বৃন্দাবন পাল লেনের ৭০ বছরের স্নেহবালা নাগ। তাঁর পুত্র-পুত্রবধূ আমস্টারডামে থাকেন। রাতের কেয়ার গিভার জ্বরে আক্রান্ত হয়ে চার দিন কাজে আসেননি। কুসুম দে নামে অন্য জনের কথায়, “আমার ছেলেটারও জ্বর। করোনা পরীক্ষা করাব ভাবছি। এই অবস্থায় তো আসা ঠিক নয়!” শোভাবাজারের হরি ঘোষ স্ট্রিটের স্বপ্না নন্দন আর তাঁর স্বামী মধুসূদনবাবু, দু’জনেরই বয়স আশির কাছাকাছি। স্বপ্নাদেবী বলেন, “ছেলের পুলিশের চাকরি। পরিবার নিয়ে মেদিনীপুরে থাকে। আগে দু’মাস অন্তর বাজার, ওষুধ কিনে দিয়ে যেত। গত তিন মাস আর আসেনি। একটি সংস্থার সদস্যপদ করে দিয়েছিল ছেলে। তারাও এখন আর আসে না।”
কালীঘাট রোডে ভাড়ার ঘরে পায়ে পচন ধরে পড়ে থাকা বৃদ্ধা কাকলি বন্দ্যোপাধ্যায়ের দাবি, স্বামীর মৃত্যুর পর থেকে মেয়ে যোগাযোগ রাখেন না। আগে পাড়ার একটি মেয়ে জল তুলে দিত। এখন সে-ও আর আসে না। কসবা সুইনহো লেনের বাসিন্দা সত্তর বছরের বৃদ্ধ শ্যামল দত্তের অভিযোগ, “বাড়িতে দাদা আছেন। তিনি চলাফেরা করতে পারেন না। গত বুধবার লকডাউনের মধ্যে তাঁর হঠাৎ শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। কসবা থানায় বারবার ফোন করেও সাহায্য মেলেনি। ফোন ধরে বলা হয়, ‘পুলিশে সবার করোনা। দেখছি কী করা যায়’। আমি নিজে প্রণামের সদস্য। একেবারেই সাহায্য পাব না ভাবিনি।” একই অভিযোগ প্রণামের একাধিক সদস্যের।
তাঁরা জানান, আগে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে যোগাযোগ রাখা, বয়স্কদের বাড়ির সামনে সিসি ক্যামেরার নজরদারি বাড়ানো, নতুন পরিচারক-পরিচারিকা রাখলে তাঁর পরিচয়পত্র জমা রাখা— এ সবই থানা করত। নির্মাণ বা সংস্কারের কাজ করানোর আগেও কোন সংস্থাকে দিয়ে করানো হচ্ছে, জানাতে বলা হত তা-ও।
কিন্তু পুলিশের সেই সব উদ্যোগই এখন উধাও।
বিভিন্ন থানায় খোঁজ করে জানা গেল, প্রণামের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিকদের বেশির ভাগই হয় সংক্রমিত, না হয় কোয়রান্টিনে। প্রণামের কাজ মূলত করছেন সিভিক ভলান্টিয়ারেরা। কলকাতা পুলিশের প্রণাম প্রকল্পের দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশকর্তা সুজয় চন্দ যদিও বলছেন, ‘‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি। এই পরিস্থিতিতেও বয়স্কদের পাশে থেকে কাজ করার চ্যালেঞ্জটা নিয়েছি আমরা। শুধু প্রণামের সদস্যেরাই নন, সকল বয়স্করাই এই সাহায্যের জন্য পুলিশের দ্বারস্থ হতে পারেন।”
তবুও বারবার সাহায্য না পেয়ে বয়স্কদের পড়ে থাকার অভিযোগ উঠছে কেন?
সুজয়বাবু স্পষ্ট কিছু বলতে না চাইলেও সমাজতত্ত্বের শিক্ষক অভিজিৎ মিত্র বলেন, “আসলে প্রত্যেকটি সম্পর্ক মেলামেশার দাবি রাখে। সেই মেলামেশা বন্ধ হয়ে গেলে মুশকিল। আর চাই সমবেদনা। পুলিশের পাশাপাশি আমরাও যদি পাশের বাড়ির বয়স্ক মানুষটির খোঁজনিই, বিপদ সামলানো অনেক সহজ হবে।”