২০১১ সালে সাপের দংশনকে ‘নেগলেকটেড ডিজ়িজ়’ বলে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। প্রতীকী ছবি।
স্বাস্থ্য দফতরের হিসাবে তিনশোর কম। আবার, বিপর্যয় মোকাবিলা দফতরের পরিসংখ্যান বলছে, ছ’শোর কাছাকাছি। সরকারি দুই দফতরকে ছাপিয়ে এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের দাবি, সংখ্যাটা আড়াই হাজার। আর বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, “আরও বেশি।”
গত বছরে রাজ্যে সর্পাঘাতে মৃতের সংখ্যা নিয়ে এমনই বিভিন্ন মত উঠে আসছে। অবশ্য শুধু রাজ্যে নয়, সারা দেশেই সাপের দংশনে মৃত্যুর ঠিকঠাক পরিসংখ্যান নেই বলেই জানাচ্ছেন সর্পদংশন বিষয়ক বিশেষজ্ঞেরা। কারণ, সব তথ্য সরকারি খাতায় নথিভুক্তই হয় না।
তবে, এখন মহকুমা বা জেলা হাসপাতালে আসছেন বহু রোগী। কিন্তু সর্পাঘাতের সেই সংখ্যা প্রকৃত সংখ্যার থেকে অনেক কম বলেই দাবি বিশেষজ্ঞদের। ২০১১ সালে সাপের দংশনকে ‘নেগলেকটেড ডিজ়িজ়’ বলে ঘোষণা করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এক যুগ পরে আজও মারাত্মক ভাবে উপেক্ষিত গোটা বিষয়টি।
গবেষণায় প্রকাশ, এ দেশে বছরে ৫৮ হাজার মানুষের সর্পাঘাতে মৃত্যু হয়। এখন সেই সংখ্যা দেড় লক্ষ বলেই অনুমান করছেন আইসিএমআর-এর সর্পদংশন প্রশিক্ষণের প্রযুক্তিগত উপদেষ্টা (টেকনিক্যাল অ্যাডভাইসর) তথা রাজ্য স্বাস্থ্য দফতরের প্রশিক্ষণ কমিটির অন্যতম প্রশিক্ষক দয়ালবন্ধু মজুমদার। তিনি বলেন, “সর্পাঘাতকে নোটিফায়েবল ডিজ়িজ় হিসাবে ঘোষণার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছে আবেদন করেছি। সেটা হলে, যেখানেই সর্পাঘাতে মৃত্যু হোক, তা সরকারি ভাবে নথিভুক্ত করতেই হবে।”
বিশেষজ্ঞেরা জানান, দেশে প্রতি বছর ম্যালেরিয়ায় যত জন মারা যান, তার চার গুণ বেশি মৃত্যু হয় সাপে কাটায়। আবার, এ রাজ্যে গত বছর জলাতঙ্কে মৃত্যু হয়েছিল ২০ জনের। কিন্তু, সাপের কামড়ে মৃত ২৪১ জন।
সারা দেশে এ হেন পর্যবেক্ষণের পরে গত বছরের সেপ্টেম্বরেই সর্পদংশনকে জাতীয় কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ২০৩০-এর মধ্যে সর্পাঘাতে মৃত্যু নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যমাত্রাও নিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। সর্পাঘাত প্রতিরোধ ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে খসড়া নির্দেশিকা তৈরি করেছে তারা। সেটি চূড়ান্ত ভাবে প্রকাশের আগে বিভিন্ন প্রান্তের সর্পদংশন বিশেষজ্ঞের মতামত জানতে চেয়ে আলোচনাও হয়েছে।
এ রাজ্য থেকে রয়েছেন দয়ালবন্ধু এবং পুরুলিয়ার দেবেন মাহাতো মেডিক্যাল কলেজের ইন্টেনসিভ কেয়ারের চিকিৎসক হিমাদ্রিকুমার পাল। তাঁরা জানাচ্ছেন, জমিতে চাষ করতে, জঙ্গলে কাঠ কাটতে এবং জলাশয়ে মাছ ধরতে গিয়েই মানুষ বেশি সর্পদংশনের শিকার হন। বর্ষাকালে সমস্যা বাড়ে। হিমাদ্রি বলেন, “সর্পাঘাতের পরে যত কম সময়ের মধ্যে অ্যান্টি স্নেক ভেনাম (এএসভি) দেওয়া যাবে, ততই মৃত্যুর হার কমবে। আমরা চাইছি, আধ ঘণ্টার মধ্যে এএসভি প্রয়োগ করা হোক।”
বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, গোখরো, কেউটে, কালাচের দংশনে স্নায়ু পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে যায়, আবার চন্দ্রবোড়ার দংশনে শরীরের রক্ত তঞ্চন ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়, বৃক্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু ঠিক সময়ে এএসভি দেওয়া গেলে বড় বিপদ থেকে রক্ষা সম্ভব।
দক্ষিণবঙ্গের পাশাপাশি উত্তরের হাসপাতালেও নিয়মিত সর্পাঘাতের রোগী আসে। ক্যানিং মহকুমায় গত দু’বছরে প্রায় ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। যদিও বেসকারি হিসাবে সংখ্যাটা বেশি। আরামবাগের প্রফুল্লচন্দ্র মেডিক্যাল কলেজের অধ্যক্ষ রমাপ্রসাদ রায় বলেন, “সারা বছরই প্রচুর সর্পাঘাতের রোগী আসেন। মাসে ৫-৭ জন ভর্তি হন। মৃত্যুও ঘটে।”
আবার, বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ সূত্রের খবর, সর্পাঘাতের রোগী ও কত জনের মৃত্যু হয়েছে, সব তথ্য পোর্টালে তুলতে হয়। যদিও বিশেষজ্ঞেরা জানান, সেই কাজে দেশ জুড়ে খামতি রয়েছে। তবে হিমাদ্রি জানান, গ্রামের প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রেই এর চিকিৎসা সম্ভব। তিনি জানাচ্ছেন, সাপে কাটা ব্যক্তিকে ফেলে রেখে সময় নষ্ট না করে, কী ভাবে এবং কত দ্রুত স্বাস্থ্য কেন্দ্রে আনা যায়, তার জন্য বাইক অ্যাম্বুল্যান্স চালুর বিষয়টিও জাতীয় কর্মসূচিতে তুলে ধরা হয়েছে। দয়ালবন্ধুর কথায়, “সর্পাঘাত বিষয়টি এমবিবিএসে সে ভাবে গুরুত্ব না পাওয়ায়, চিকিৎসার জন্য ভরসা জেলা বা মেডিক্যাল কলেজ স্তরের হাসপাতাল। তবে এ রাজ্য সে দিক থেকে এগিয়ে। এখানে চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রের চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।”