—প্রতীকী ছবি।
দিনের পর দিন, বছরের পর বছর চলছে একই পরিস্থিতি। সরকারি হাসপাতাল ও মেডিক্যাল কলেজগুলিতে সময়ে আসছেন না সিনিয়র চিকিৎসকেরা। কর্মসংস্কৃতির এই হাল দেখে রোগীরা বিরক্ত হলেও চিত্রটা বদলায় না কিছুতেই।
অভিযোগ, নিয়ম মেনে সকাল ৯টায় বহির্বিভাগে ডাক্তারেরা আসছেন না শহরের প্রায় কোনও মেডিক্যাল কলেজেই। কেন নির্দিষ্ট সময়ে চিকিৎসকেরা হাসপাতালে উপস্থিত থাকছেন না, তা নিয়ে সম্প্রতি ‘ন্যাশনাল মেডিক্যাল কমিশন’ (এনএমসি)-ও প্রশ্ন তুলেছে। শো-কজ় করা হয়েছে শহরের মেডিক্যাল কলেজগুলিকেও। কিন্তু তার পরেও যে চিকিৎসকদের একাংশের টনক নড়েনি, তা স্পষ্ট।
কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের পরে বৃহস্পতিবার নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ঘুরেও দেখা গেল, সময়ে বহির্বিভাগে চিকিৎসকদের না থাকারই ছবি। এ দিন সকালে সাড়ে ৯টা-পৌনে ১০টা বেজে গেলেও ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগের উল্টো দিকে, বহির্বিভাগ বিল্ডিংয়ের একতলা, দোতলা ও তেতলায় বিভিন্ন ঘরই ছিল ফাঁকা। বাইরে তখন অসংখ্য রোগীর ভিড়। যাঁদের অনেকেই চিকিৎসার জন্য বহু দূরের জেলা থেকে এসেছেন। তাঁদের অনেকেই জানেন না, কখন চিকিৎসককে দেখিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন। তবে, অধিকাংশ সিনিয়র চিকিৎসকেরই দাবি, তাঁরা অন্তর্বিভাগে রাউন্ড দিয়ে তবে বহির্বিভাগে আসেন। কিন্তু তাঁদের জুনিয়রেরা এসে আগে কাজ শুরু করে দেন।
কিন্তু এ দিন নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও এনআরএসের মেডিসিন, শল্য, হৃদ্রোগ, হেমাটোলজি, নাক-কান-গলা বিভাগের বহির্বিভাগে দেখা মেলেনি কোনও স্তরের চিকিৎসকেরই। অস্থি বিভাগে দু’জন চিকিৎসক থাকলেও তা ছিল রোগীদের ভিড়ের তুলনায় কম। এনআরএসের সুপার ইন্দিরা দে বললেন, ‘‘বহির্বিভাগে সময় মতো চিকিৎসকেরা আসছেন কি না, তা প্রায়ই খতিয়ে দেখা হয়। এ দিন কী হয়েছে, তা দেখতে হবে।’’ এ দিন সকাল ৯টা ২০ মিনিটে বহির্বিভাগ বিল্ডিংয়ের একতলায় দেখা গেল, কার্ডিয়োলজির টিকিট নথিভুক্তির কাউন্টারে লম্বা লাইন। ভিতরে তখনও কোনও চিকিৎসক আসেননি। গেদে থেকে ইকো করানোর জন্য এ দিন এনআরএসে এসেছিলেন প্রৌঢ়া সাবিনা খাতুন। তাঁর কথায়, ‘‘ভোরের ট্রেন ধরে এসেছি। ডাক্তারবাবু না লিখে দিলে তো ইকো হবে না। তিনি কখন আসবেন, জানি না।’’ ৯টা ৪০ নাগাদ দেখা গেল, নিরাপত্তারক্ষীরা লাইনের সামনে গিয়ে বলছেন, ‘‘টিকিট হাতে রাখুন। এখনই ডাক্তারবাবু আসবেন।’’
আবার সকাল ৯টা ২০ মিনিটে বহির্বিভাগ বিল্ডিংয়ের দোতলায় গিয়ে দেখা গেল, জেনারেল মেডিসিনের একের পর এক কেবিন ফাঁকা। এক নম্বর ঘরের সামনে হাতে গাদা প্রেসক্রিপশন নিয়ে দাঁড়িয়ে এক রোগীর পরিজন রবিউল শেখ। বললেন, ‘‘ডাক্তারবাবুরা ১০টা, সাড়ে ১০টার আগে আসেন না। এখন দেখি, কখন আসেন।’’ জেনারেল মেডিসিনের এ দিনের ইউনিট ইন-চার্জ, চিকিৎসক সঞ্জয় সরকারের কথায়, ‘‘কাকে কখন আসতে হবে, সবই জানানো আছে। কিন্তু কে কেন দেরিতে এসেছেন, সেটা খোঁজ নিয়ে বলতে হবে।’’
সকাল ৯টা ৪০ মিনিটেও ফাঁকা ৯-এ নম্বর ঘরের মহিলা শল্য বিভাগের চিকিৎসকের চেয়ার। সকাল থেকে অপেক্ষা করে কেউ কেউ বেঞ্চে বসেই দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন। পাশে ৯-বি নম্বর ঘরে পুরুষ শল্য বিভাগে রয়েছেন কম বয়সি এক জন চিকিৎসক। সেখানে লাইন সরছে খুবই ঢিমেতালে। এ দিনের ইউনিটের দায়িত্বে থাকা চিকিৎসক সঞ্জয় মৈত্র বললেন, ‘‘এমনটা হওয়ার কথা নয়। আমি অন্তর্বিভাগে রাউন্ড দিয়ে আসি। কিন্তু অন্যদের তো সময়ে চলে আসার কথা। বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি।’’ কিছুটা এগিয়ে বাঁ হাতে রয়েছে ৯-ডি নম্বর ঘর। সেখানে চলে জেনারেল ওপিডি। সাড়ে ৯টা বেজে গেলেও সেই ঘরে চিকিৎসক তো ছিলেনই না, পাশে বসা টিকিট নথিভুক্ত করার কর্মীরও দেখা মিলল না।
কয়েক হাত দূরেই একটি ঘরের সামনে তখন প্রচণ্ড ভিড়। নাক-কান-গলা বিভাগে ঢুকে দেখা গেল, ভিতরে সব কেবিনই ফাঁকা। বাইরে অপেক্ষায় অসংখ্য রোগী। সকাল পৌনে ১০টা বাজলেও ঘরে চিকিৎসকদের দেখা নেই কেন? সরাসরি মন্তব্য করতে রাজি না হলেও এক সিনিয়র চিকিৎসক শুধু বললেন, ‘‘এক জন ইন্টার্ন কিন্তু কাজ শুরু করেছিলেন।’’ কিন্তু ইন্টার্নদের দিয়ে তো বহির্বিভাগ চালানোর কথা নয়। তা হলে কেন এমনটা হচ্ছে? সেই প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।
টিকিট করানোর পরে তা আসে হেমাটোলজি বিভাগের রক্ত পরীক্ষার ঘরে। সেখানে পরীক্ষা হলে তবেই ওই বিভাগের চিকিৎসককে দেখাতে পারেন রোগীরা। কিন্তু অভিযোগ, পরীক্ষা করতেই দুপুর গড়িয়ে যায়। যেমন, ঘটকপুকুরের বাসিন্দা এক প্রৌঢ়াকে ওই বিভাগের বাইরে স্ট্রেচারে শুইয়ে রেখে পরিজনদের আক্ষেপ, ‘‘বিনা পয়সায় চিকিৎসা করাতে গিয়ে কত ক্ষণ অপেক্ষা করতে হবে, কে জানে।’’ হেমাটোলজির বিভাগীয় প্রধান তুফানকান্তি দলুই বলছেন, ‘‘কখনওই এমনটা কাম্য নয়। রক্ত পরীক্ষার টেকনিশিয়ানদের সঙ্গে কথা বলব এবং সমস্যার কথা কর্তৃপক্ষকেও জানাচ্ছি।’’