সফ্টওয়্যার আগেই ছিল। এ বার হাজির অ্যাপ। দুষ্টের দমনে কলকাতা পুলিশের নয়া হাতিয়ার।
পুলিশ বলছে, অপরাধীদের তথ্যপঞ্জী সব সময়ে হাতের নাগালে রাখতে চালু করা হচ্ছে ক্রিমিন্যাল ট্রাকিং সিস্টেমস (সিটিএস) নামে ওই অ্যাপ। লালবাজারের দাবি, দাগি দুষ্কৃতীদের গতিবিধি নজরে রাখতে বিশেষত নির্বাচনের আগে সাহায্য করবে এটি। এর ফলে কোন দুষ্কৃতী কোন এলাকায় সক্রিয়, তার বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ আছে, হাতের স্মার্টফোনেই মিলবে সেই তথ্য। তার উপরে কোনও নতুন পুলিশ অফিসারের হাতে পড়ে যাতে দাগিরা পালিয়ে না যেতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করা যাবে। এক পুলিশ অফিসারের কথায়, ‘‘হতেই পারে চুনো মাছ ধরতে গিয়ে জালে রাঘব বোয়াল ফেঁসে গেল। তখন সেটা দেখিয়েই নির্বাচন কমিশনের বাহবা কুড়োনো যাবে।’’
গত নভেম্বরে কসবায় ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেফতার করা হয়েছিল বাচ্চু হালদার নামে এক অভিযুক্তকে। কিন্তু ছিঁচকে অপরাধী হওয়ায় গ্রেফতারের কয়েক দিনের মধ্যেই জামিন হয়ে যায় তার। তদন্তকারী অফিসার জানতে পারেন, হরিদেবপুরের একটি খুনের ঘটনাতেও যুক্ত ছিল বাচ্চু। যাদবপুর, গরফা থানায় একাধিক দুষ্কর্মে অভিযুক্ত সে। কিছু মামলায় তাকে খুঁজছিল পুলিশ। এ সব দেখে কসবার তদন্তকারী অফিসার যখন মাথার চুল ছিঁড়ছেন, তত ক্ষণে বাচ্চু পগারপার!
পুলিশেরই দাবি, অপরাধীদের তথ্য সংবলিত ‘ক্রাইমবাবু’ সফ্টওয়্যার রয়েছে প্রতিটি থানার কম্পিউটারেই। কসবা থানার ওই অফিসার সফ্টওয়্যার ঘাঁটলেই সব তথ্য পেয়ে যেতেন। সেই কাজটাকেই এই নয়া অ্যাপ আরও সহজ করে তুলবে বলে মনে করছে লালবাজার। ইতিমধ্যে ২২ মার্চ থেকে কিছু থানায় এবং গুন্ডাদমন শাখার অফিসারদের ফোনে এই অ্যাপ দেওয়া হয়েছে। পরে বাকি থানা এবং অন্য শাখার অফিসারদেরও তা দেওয়া হবে। ওই অ্যাপে থাকবে আলিপুর ও প্রেসিডেন্সি জেলে বন্দি দুষ্কৃতীদের তথ্যও।
তবে অ্যাপটি এখনও যে অবস্থায় রয়েছে, তাতে এই বিধানসভা নির্বাচনেই যে তা খুব বেশি কাজে লাগবে, এমনটা মনে করছেন না অনেকেই। লালবাজারের কর্তাদের একাংশই বলছেন, আগামী যে কোনও নির্বাচন থেকে এই অ্যাপ কলকাতা পুলিশের মুশকিল আসান হয়ে উঠতে পারে। পুলিশ সূত্রে খবর, কয়েক মাস আগে সাউথ সাবার্বান ডিভিশনে পরীক্ষামূলক ভাবে এলাকাভিত্তিক এ রকম একটি অ্যাপ চালুর চেষ্টা হয়েছিল। যদিও তার বিশেষ অগ্রগতি হয়নি। রাজীব কুমার কলকাতা পুলিশের কমিশনার হওয়ার পরে গোয়েন্দা বিভাগকে এই অ্যাপ তৈরির দায়িত্ব দেন। তাঁর নির্দেশেই ডিসি ডিডি (দ্বিতীয়) নগেন্দ্র সিংহ ত্রিপাঠী প্রযুক্তিবিদদের সাহায্যে এই অ্যাপটি তৈরি করেন। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ দমন) দেবাশিস বড়াল বলেন, ‘‘অপরাধীকে দ্রুত চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্যই এই প্রচেষ্টা।’’
কিন্তু ‘ক্রাইমবাবু’ থাকতে ফের নতুন অ্যাপ কি জরুরি ছিল? লালবাজারের কর্তাদের যুক্তি, ওই সফটওয়্যারটি ব্যবহার করার ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা ছিল। কারণ, থানার কম্পিউটারে থাকা ওই তথ্য যে কোনও জায়গায় বসে ব্যবহার করা সম্ভব নয়। তার উপরে অনেকেই কম্পিউটার ঘাঁটতে চান না। এ ক্ষেত্রে মোবাইলে অ্যাপ এনে অপরাধীদের তথ্যপঞ্জী খোঁজার বিষয়টিকে আরও সহজ করে তোলা হচ্ছে। যদিও পুলিশের একাংশের মতে, অফিসারেরা অনেক সময়েই অপরাধীকে ধরার পরে তার ইতিহাস খুঁজে বার করার ক্ষেত্রে সক্রিয় হন না। সে ক্ষেত্রে কম্পিউটারে সফ্টওয়্যারই থাক বা স্মার্টফোনে অ্যাপ—কাজের কাজটা হবে কি?
বস্তুত, অপরাধীদের তথ্যপঞ্জী তৈরির ক্ষেত্রে লালবাজারের ‘ক্রাইম রেকর্ড সেকশন’ রয়েছে। সেখান থেকে তথ্য খুঁজে তড়িঘড়ি অপরাধের কিনারা হয়েছে, এমন নজিরও রয়েছে। তবে পুলিশের অনেকে বলছেন, ছুটির দিনে ওই শাখা বন্ধ থাকলে তথ্য মেলে না। তা ছাড়া, কলকাতা পুলিশের আওতাধীন এলাকা যে ভাবে বেড়ে গিয়েছে, তাতে তথ্য খুঁজতে দূর থেকে সরকারি তেল পুড়িয়ে আসাটাও ঝঞ্ঝাটের। একসঙ্গে একাধিক থানার অফিসারেরা ওই শাখায় হাজির হলে তথ্য ঘাঁটতে প্রচুর সময়ও লেগে যায়। এই কারণেই প্রযুক্তিনির্ভর নতুন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হচ্ছে। এক পুলিশকর্তা বলেন, ‘‘অপরাধ ও অপরাধীদের তথ্যপঞ্জী কম্পিউটারে ভরে দেওয়ার প্রকল্প কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারও নিয়েছে। তার মধ্যে রাজ্যগুলি আবার আলাদা আলাদা ব্যবস্থা গড়ছে।’’