বাড়ির নতুন রং করা অংশেই ভাড়া থাকতেন প্যালারাম তথা নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়। নিজস্ব চিত্র
ঝন্টি পাহাড়ের স্টেশনে নেমেই এক ডজন সিঙাড়া আর দু'প্লেট আলুরদম সাবাড়। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না টেনিদার। তাই জঙ্গলের পথে হাঁটার সময়ে দক্ষিণের বাতাসে ফের খিদে পেতেই প্যালারামের বিস্কুটের প্যাকেট নিমেষে শেষ করে দিয়েছিলেন পটলডাঙার চার মূর্তির পাণ্ডা টেনিদা।
সাহিত্যিক নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের সৃষ্টি ছ’হাত লম্বা, খাঁড়ার মতো নাক এবং গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে বিখ্যাত টেনিদা অবশ্য জেগে রয়েছেন কলকাতার বুকে। আমহার্স্ট স্ট্রিট ও হ্যারিসন রোডের সংযোগস্থল থেকে কয়েক কদম এগোলেই সরু গলি। ঢুকে কয়েক পা এগোলেই ডান হাতে মিলবে আরেক তস্য গলি। শিয়ালদহ অঞ্চলের সেই গলি আজও বহন করছে ‘ভূতে বিড়ি খায় না, কোথায় লেখা রয়েছে’—প্রশ্ন তোলা টেনিদার স্মৃতি। সঙ্গে রয়েছে প্যালারাম, ক্যাবলা, হাবুল আর চ্যাটুজ্জেদের রোয়াক।
সময়ের সঙ্গে বদলেছে শহরটা। পটলডাঙা স্ট্রিটের সেই তস্য গলিটা একই রকম থাকলেও বদলেছে টেনিদার বাড়ি এবং চার মূর্তির আড্ডার রোয়াক। তবে বদল যাই হোক না কেন, এক গলির পেট ফুঁড়ে যাওয়া আরেক গলির প্রবীণ বাসিন্দারা অবশ্য আজও মনে রেখেছেন বাস্তবের টেনিদা তথা পটলডাঙা স্ট্রিটের ২০ নম্বর বাড়ির বড় ছেলে প্রভাত মুখোপাধ্যায়কে। তাঁর বাড়িরই ভাড়াটে নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়কেও যে ভোলা যায় না, তা-ও মানেন এলাকার প্রবীণেরা। তাঁদের কথায়, ‘‘বাস্তবের টেনিদার থেকে শোনা গল্পকে কল্পনার মাধ্যমে হাসির কিশোর সাহিত্যে পরিণত করেছিলেন নারায়ণবাবু। তাই আজও পটলডাঙা বলতে লোকে টেনিদার পাড়া বোঝেন।’’
আর বাংলা সিনেমার টেনিদা বলতে সকলে চেনেন অভিনেতা চিন্ময় রায়কে। নায়ারণবাবুর ‘চার মূর্তি’ গল্প নিয়ে ১৯৭৮ সালে পরিচালক উমানাথ ভট্টাচার্যের সিনেমায় টেনিদা চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন রোগাপাতলা চেহারার চিন্ময়বাবু। কথায় কথায় ভয় পেয়ে চিন্ময়বাবুর ভিরমি খাওয়ার দৃশ্য আজও মনে রেখেছেন দর্শকেরা। তবে সিনেমা ও বাস্তবের টেনিদাকে মেলাতে চান না পটলডাঙার বাসিন্দারা।
এখন টেনিদার পাড়াটা একটু অন্য রকম। স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, হাত বদল হয়েছে ২০ নম্বরের বাড়িটা। সেই বাড়ির নীচে চলছে ছাপাখানা। বাড়ির গায়েও নতুন রঙের প্রলেপ। আর তস্য গলির মুখে থাকা মুখোপাধ্যায় (গল্পে নাম বদলে চাটুজ্যে) বাড়িরও মালিকানা বদলে রোয়াকটা জালে ঘিরেছে। প্রভাতবাবুর বাড়ির বিপরীতে ২২এ বাড়ির সদস্য জলেশ মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘একদম প্রথমে নারায়ণবাবু আমাদের বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। পরে তিনি প্রভাতবাবুদের দোতলা বাড়ির ভাড়াটে হয়েছিলেন।’’
পরীক্ষা শেষে ঝন্টি পাহাড়ে যাওয়ার আগে ক্যাবলার বাড়িতে নিমন্ত্রণে টেনিদার খাওয়া দেখে প্যালারামের পিলে বেরিয়ে আসার জোগাড় হয়েছিল। বাস্তবের টেনিদা আর নারায়ণবাবুও খুবই খাদ্য রসিক ছিলেন বলেই জানান জলেশবাবু। এক ম্যাচে টেনিদার ৩২টি গোল কি সত্যি? হেসে ফেললেন এলাকারই প্রবীণ বাসিন্দা প্রদীপ মৈত্র। বললেন, ‘‘সেটা ঠিক জানি না। মনে হয় নারায়ণবাবুরই সৃষ্টি সেটা। তবে রোয়াকের সামনের খোলা জায়গায় যখন ক্রিকেট খেলতাম তখন মাঝেমধ্যে হাফহাতা গেঞ্জি আর লুঙ্গি পরে টেনিদা আসতেন। ছোটদের এক একটা কাল্পনিক নাম ধরে ডেকে খুব হাসাতেন। মজার গল্প বলতেন।’’ ছ’ফুট লম্বা, ছিপছিপে চেহারার প্রভাতবাবুর সেই সব মজার গল্পে ভর করেই পটলডাঙার ওই বাড়িতে বসে নারায়ণবাবু তৈরি করে ছিলেন টেনিদাকে। যে কি না কাউকে কাবু করতে হুঙ্কার ছাড়ত ‘এমন তিন নম্বর চামচে প্যাঁচ দেব না’। আবার ছেলে বেলায় টিংটিঙে চেহারায় প্রভাতবাবুর ইয়া বড় চ্যাং ঘুড়ি ওড়ানোর গল্পের সূত্রেই তৈরি ‘ঢাউস’ নামের গল্প।
প্রদীপবাবু জানান, এক বার তাঁরা বন্ধুরা মিলে বাড়িতে নারায়ণবাবুর ‘ভাড়াটে চাই’ নাটক করেছিলেন। লেখক নিজে সেটি দেখতে আসেন। উত্তমকুমার, প্রেমেন্দ্র মিত্রের মতো বিখ্যাত লোকজনও আসতেন ওই সরু গলির বাসিন্দা নারায়ণবাবু তথা প্যালারামের বাড়িতে। কিন্তু হাবুল আর ক্যাবলা, তাঁরা কে? জানা গেল, ওই দুই চরিত্র ছিল প্রভাতবাবুর দুই ভাইয়ের নাম। হাবুর সঙ্গে ‘ল’ যোগ করে নায়ারণবাবু বানিয়ে ছিলেন হাবুল। যদিও তাঁদের বাস্তবের চরিত্রের সঙ্গে গল্পের কোনও মিল ছিল না।
চারমূর্তি সিনেমার টেনিদা চিন্ময় রায়ের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল বাস্তবের টেনিদা, প্রভাতবাবুর। কী কথা হয়েছিল সে দিন, তা অবশ্য জানার উপায় নেই। সকলেই আজ স্মৃতি।
তবে শহরের ওই তস্য গলিতে এখনও কান পাতলে শোনা যায়, ‘ডি-লা-গ্রান্ডি-মেফিস্টোফিলিস’। তার পরেই ‘ইয়াক ইয়াক ইয়াক’।