গ্রাফিক- শৌভিক দেবনাথ
রাতভর বৃষ্টি। সকালে হতেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ল বেনিয়াটোলার জরাজীর্ণ বাড়ির সিঁড়ি। অল্পের জন্য রক্ষা পেলেন বাড়ির মালিক এবং ভাড়াটের পরিবার। দোতলায় আটকে পড়েন সবাই। তাঁদের উদ্ধার করতে এসে এক পুর কর্মী বলেই ফেললেন, “সতর্ক করার পরও কেউ বাড়ি ছাড়তে রাজি ছিলেন না। বরাত জোরে বেঁচে গেল দশটি প্রাণ।” শুক্রবার দুর্ঘটনার পর, পাশের একটি বাড়ি থেকে সিঁড়ি লাগিয়ে তাঁদের উদ্ধার করে দমকল।
ইতিহাসের এই শহরে প্রায় ইতিহাস হতে বসা জীর্ণ বাড়ি একটা নয়।কিছু দিন আগে বৈঠকখানা বাজারের মুড়িপট্টিতে বাড়ির একংশ ভেঙে পড়ে। ওই বিপজ্জনক বাড়িটিও ছাড়তে রাজি ছিলেন না ব্যবসায়ীরা। মালিককে নোটিস পাঠিয়ে কাজ হয়নি। তার খেসারত দিতে হল দু’টি প্রাণ দিয়ে
এর পরও হুঁশ ফিরছে না অন্যদের। আশপাশ দিয়ে বাস, গাড়ি গেলে ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে বাড়িগুলো। কোনওটার বয়স একশো বছর, কোনওটা দু’শো বছরের দোরগোড়ায়। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একেবারে জরাজীর্ণ অবস্থা। কোথাও চাঙড় ভেঙে ঝুলছে। কোথাও ভেঙে পড়েছে ছাদের একাংশ। যে কোনও মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়তে পারে জেনেও, সেখানে প্রাণ হাতে নিয়ে বসবাস করছেন মানুষজন। একটা বা দু’টো নয়, কলকাতা শহরের বুকে এমন বিপজ্জনক বাড়ি রয়েছে প্রায় তিন হাজার।
সমস্যা হল, সেখানে বসবাসকারী বাসিন্দা এবং ভাড়াটেদের কাউকে সরাতে পারছে না কলকাতা পুরসভা। দু’পক্ষের বিবাদে বাড়ি মেরামতিতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না কেউ। এমনকী, উচ্ছেদের আশঙ্কায় পুরসভা টেন্ডার ডেকে মেরামতির উদ্যোগেও তাঁদের আপত্তি রয়েছে।
বর্ষার শুরুতেই শিয়ালদহ এলাকায় ভেঙে পড়া বাড়ি। ফাইল চিত্র।
বিরোধীদের অভিযোগ, নতুন আইন হয়েছে। কিন্তু সেই আইন প্রয়োগ করতে কিছুটা ‘অনীহা’ রয়েছে পুর কর্তাদের। ‘ভোট ব্যাঙ্ক’-এর জন্যেই কাউকে চটাতে নারাজ তৃণমূল পুরবোর্ড। উল্টে বুঝিয়ে সুঝিয়েই কাজ হাসিল করতে চাইছে তারা। এই ‘কাউন্সেলিং’ করতে গিয়েই মাসের পর মাস চলে কেটে যাচ্ছে। আর বাড়ি ভেঙে মরছে মানুষ।
আরও পড়ুন: ঘন ঘন ফোন, সামনে খোলা ল্যাপটপ, রেস্তরাঁ কর্মীর গোয়েন্দাগিরিতে জালে প্রতারণা চক্র
পুরসভা সূত্রে খবর, তিন হাজারের মধ্যে মাত্র ৫০ জন বিপজ্জনক বাড়ির মালিকের কাছে নোটিস গিয়েছে। শুধু তাই নয়, মাত্র ১৩ বাড়ির মালিক এবং ভাড়াটেকে এক টেবিলে বসানো গিয়েছে। এইটুকুই যা সাফল্য।
উত্তর কলকাতা, খিদিরপুর, ভবানীপুরেই এই ধরনের বাড়ির সংখ্যা বেশি। কিছু দিন আগেই বৈঠকখানা বাজারে দুর্ঘটনায় প্রাণ গিয়েছে দু’জনের। পাথুরিয়াঘাটা স্ট্রিটে বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে পড়ার পর মুখ্যমন্ত্রী উদ্যোগে বিধানসভায় বিল পাশ হয়ে বিল্ডিং আইনে ৪১২এ ধারা যুক্ত হয়।
আরও পড়ুন: ঘোড়পুলিশের বাহিনীতে নয়া একাদশ
তার পরই তিনি পুর প্রশাসনকে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন। কিন্তু বাস্তবে তার প্রতিফলন নেই বলে অভিযোগ। নতুন ধারায় বিপজ্জনক বাড়ি ভাঙার ক্ষেত্রে প্রথমে সুযোগ দেওয়া হবে মালিকপক্ষকে। তিনি রাজি না হলে পুর প্রশাসন টেন্ডার করে কোনও সংস্থাকে বরাত দিতে পারে। ওই সময়ে বাড়ির বাসিন্দাদের পুনর্বাসন দিতে হবে। বিপজ্জনক বাড়ি ভেঙে নতুন বাড়ি তৈরি করলে বাড়তি ১০০% ছাড় (এফএআর) দেওয়া হবে বলে জানায় পুরসভা।
এক ইঞ্জিনিয়ারের কথায়, “আমাদের হাত-পা বাঁধা। আইন রয়েছে। কিন্তু প্রয়োগ করা যাচ্ছে না। মালিক বা ভাড়াটে, কেউ বাড়ি মেরামতির বিষয়ে সদিচ্ছা দেখাচ্ছেন না। একে অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপাতেই ব্যস্ত। এখনও কলকাতার বুকে ২০ থেকে ৫০, ৬০ টাকা ভাড়ার থাকেন মানুষ। শরিকি সমস্যাও রয়েছে। অনেকে উচ্ছেদের ভয়েই ঘর ছাড়তে চান না।”