জগদীশচন্দ্র বসু এক নভেম্বরের সকালে আকস্মিক হৃদ্রোগে প্রয়াত হন গিরিডিতে। সালটা ১৯৩৭। সত্যজিৎ সেই প্রয়াণ-সংবাদ খবরকাগজ থেকে কেটে, সেঁটে রেখেছিলেন স্ক্র্যাপবুকে, তাঁর বয়স তখন ষোলো। গিরিডিতে বিজ্ঞানী শ্রীবসুর এই মৃত্যুর সূত্রে কারও মনে পড়তেই পারে, গিরিডি নিয়ে নিজের দু’বছর বয়সের স্মৃতি লিখে গিয়েছেন সত্যজিৎ। অকালে অসুখে পড়েন সুকুমার, মাঝেমধ্যে একটু সুস্থ বোধ করলে তাঁকে চেঞ্জে নিয়ে যাওয়া হত, তেমন ভাবেই বাবার সঙ্গে গিরিডি গিয়েছিলেন সত্যজিৎ, লিখেছেন “গিরিডির ঘটনায়... আছে আমাদের বুড়ো চাকর প্রয়াগ। আমি আর প্রয়াগ সন্ধ্যাবেলা উশ্রীর ধারে বালিতে বসে আছি। প্রয়াগ বলল, বালি খুঁড়লে জল বেরোয়। আমি ভীষণ উৎসাহে বালি খুঁড়তে শুরু করলাম...” (যখন ছোট ছিলাম, আনন্দ)। ওই স্ক্র্যাপবুক ও আত্মস্মৃতি থেকে সত্যজিৎ-ভক্ত বা গবেষক পৌঁছে যেতেই পারেন প্রোফেসর শঙ্কু-তে। শঙ্কুও বিজ্ঞানী, ঠিকানা গিরিডি, তিনিও ভোরে ঘুম থেকে উঠে উশ্রী নদীর ধারে বেড়াতে যান, সঙ্গী ভৃত্য প্রহ্লাদ ও বিড়াল নিউটন।
লকডাউনে সেই স্ক্র্যাপবুক খুঁজে পেয়েছেন সন্দীপ রায়, গাঢ় সবুজ রঙের বাঁধানো মলাটে লেখা: ১৯৩৭-৩৮, এটিই এ বারে তাঁর সম্পাদিত সন্দেশ-এর শারদীয়া সংখ্যার মুখ্য আকর্ষণ। দেশি-বিদেশি সংবাদপত্র ও ম্যাগাজ়িন থেকে হরেক ছবি ও খবর, এমনকি কার্টুনও জড়ো করেছিলেন বয়ঃসন্ধির সত্যজিৎ এই স্ক্র্যাপবুকে। কী নেই তাতে! ব্র্যাডম্যানের সেঞ্চুরির রেকর্ড, হেলেন কেলার কী ভাবে সব প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে হয়ে উঠছেন এক ‘লিভিং মিরাকল’, রবীন্দ্রনাথের ছবি ও তাঁর ৭৮তম জন্মদিনের বার্তা কালিম্পং থেকে, লরেল-হার্ডির কমেডি, ওয়াল্ট ডিজ়নি, টেলিভিশনের অগ্রগতি... আরও কত কী।
“সিধুজ্যাঠার মতো বাবারও যে কত বিষয়ে ইন্টারেস্ট ছিল, এই স্ক্র্যাপবই দেখলেই আন্দাজ পাওয়া যায়,” মন্তব্য সন্দীপের। কিছু কার্টুনও এঁকেছিলেন সত্যজিৎ, ডি জে কিমার-এ কর্মরত তখন, অপ্রকাশিত সে সবেরই একটি ‘আমেরিকান টুরিস্ট ইন প্যারিস’, ছাপা হচ্ছে এই শারদীয় সংখ্যায়। ডি জে কিমার-এর কাজেই জাহাজে চেপে বিজয়া রায়-সহ বিলেত গিয়েছিলেন সত্যজিৎ ১৯৫০-এর এপ্রিলে (সেখানে তোলা তাঁদের দু’জনের ছবি, ডান দিকে), সেখান থেকে সুপ্রভা রায়কে লেখা তাঁর চিঠিপত্রও থাকছে এই সংখ্যায়। একটি চিঠি থেকে জানা যাচ্ছে, সে বছরই জুন মাসে আন্তর্জাতিক জার্নাল গ্রাফিস-এ ছাপা হচ্ছে সত্যজিতের আঁকা একটি বইয়ের প্রচ্ছদ, “Graphis-এ বেরোনোর চেয়ে বড় সম্মান আর Commercial Artistএর কিছু থাকতে পারে না।”— মা’কে লিখছেন সত্যজিৎ। তাঁর ১৯৩৬ সালে লেখা ডায়েরি, আর নিজের গল্পের জন্য আঁকা কিছু রঙিন ও সাদা-কালো হেডপিস-ও থাকছে সংখ্যাটিতে। এক কথায় শারদীয় সন্দেশ এ বার সত্যজিৎময়। প্রচ্ছদের ছবিটি (বাঁ দিকে) সন্দীপ রায়েরই তোলা, ১৯৭৮-এ ক্যালকাটা মুভিটোন স্টুডিয়োয় জয় বাবা ফেলুনাথ-এর সেটে প্রতিমায় রং বোলানোয় ব্যস্ত সত্যজিৎ, তেতাল্লিশ বছর পরেও কী জীবন্ত! ছবি সৌজন্য: সন্দীপ রায়
সঙ্গীতপ্রাণ
কমল দাশগুপ্তর সুর করা ‘শুধু জাগিতে এসেছি রাতে’ ওঁর বড় প্রিয় গান। কিন্তু সে গান রেকর্ড করেও নাম পাননি রামকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৯২১-২০০৯) (ছবিতে), সেই খেদ পরে মিটল কীর্তন আর পুরাতন বাংলা গানে রাজার আসন পেয়ে। এই মানুষটিকেই একদা বাড়ি বাড়ি গিয়ে গানের টিউশনি করতে হয়েছে, সাক্ষী লেখক সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়। কুমার বসুর স্মৃতিতে উজ্জ্বল আসরে আর রেকর্ডেও ওঁর সঙ্গে বাজানো। রাজ্যশ্রী ঘোষের কণ্ঠে সপ্রাণ বাবু রামকুমারের শেখানোর বিরল শৈলী। এই সবই শোনা গেল গত ২২ সেপ্টেম্বর সন্ধেয়, ‘রবীন্দ্রভারতী সোসাইটি’-র আন্তর্জাল-আয়োজনে, সোসাইটি-সম্পাদক সিদ্ধার্থ মুখোপাধ্যায়ের মুখ্য উদ্যোগে। সঞ্চালনায় ছিলেন শিল্পীপুত্র শ্রীকুমার চট্টোপাধ্যায়, হৈমন্তী শুক্ল গাইলেন দু’-চার কলি। স্মৃতি উস্কে দেওয়া মরমি আয়োজনে উদ্যাপিত হল বাংলার এই কণ্ঠবাদনের খলিফার জন্মশতবর্ষ।
শারদ বৈঠক
১৮৮৯ সালে স্থাপিত ‘চৈতন্য লাইব্রেরি অ্যান্ড বিডন স্কোয়ার লিটারারি ক্লাব’ সুদীর্ঘ কাল ধরে সাহিত্যপ্রেমীদের মনের তেষ্টা তো মেটাচ্ছেই, নিয়মিত করে আসছে বিষয়ভিত্তিক আলোচনা ও সাহিত্যসভাও। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই প্রাঙ্গণে নিয়মিত বক্তৃতা দিয়েছেন। অতিমারি-পর্বেও সেই ঐতিহ্য অক্ষুণ্ণ রাখতে দানী ঘোষ সরণির এই গ্রন্থাগার-কর্তৃপক্ষের উদ্যোগে গতকাল ১ অক্টোবর থেকে শুরু হয়েছে বৈঠকি আড্ডা ও উৎসব মেলা ১৪২৮। চলবে আগামী কাল ৩ অক্টোবর পর্যন্ত, বিকেল ৫টা থেকে রাত ৮টা। আছে লোকগানের অনুষ্ঠান, শ্রুতিনাটক, অনলাইন অঙ্কন প্রতিযোগিতা। উদ্বোধনে কথা হল কোভিডকালে শারদোৎসব নিয়ে।
সগৌরবে
১৯০৬-এ ‘অরোরা’ প্রতিষ্ঠা করেন অনাদিনাথ বসু, কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিটে। কালক্রমে সংবাদচিত্র, তথ্যচিত্র, পরে ১৯২১-এ নির্বাক ছবিরও নির্মাতা অরোরা। ১৯৪৬-এ দ্বিতীয় কর্ণধার অজিত বসুর চেষ্টায় বাংলা চলচ্চিত্রের দ্যুতি ছড়িয়ে পড়ল সারা দুনিয়ায়, স্বাধীনতার অব্যবহিতে সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণাল প্রমুখের বাংলা ছবি দেশে ও বিদেশে সম্মানিত হতে শুরু করল। বিধাননগরে অরোরা গড়ে তুলল পূর্ব ভারতের প্রথম বাতানুকূল ফিল্ম স্টুডিয়ো। বর্তমান কর্ণধার অঞ্জন বসুর উদ্যোগে অতিমারি উপেক্ষা করেই সম্পূর্ণ ডিজিটাল পদ্ধতিতে তৈরি হয়েছে কাহিনিচিত্র কালকক্ষ। পরিচালক রাজদীপ পাল ও শর্মিষ্ঠা মাইতি সত্যজিৎ রায় ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের প্রাক্তনী, জাতীয় পুরস্কারে সম্মানিত। ২৬তম বুসান চলচ্চিত্র উৎসবে নির্বাচিত এ ছবি। অনেক দিন পরে বাংলা ছবি আবার বিশ্ব-চলচ্চিত্রের মানচিত্রে।
মানুষের কথা
১৯৮৯ সালে যাত্রা শুরু ‘নাগরিক মঞ্চ’-র, এক অদলীয় সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে। তিন দশক জুড়ে চিরাচরিত উন্নয়নের ধারণা ও বিপন্ন শ্রমিক-শিল্প-পরিবেশ ভারসাম্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে এই মঞ্চ— আন্দোলনে ও আইনি সহায়তায়। সঙ্গে প্রকাশনার কাজও, কেননা নাগরিক গোষ্ঠীর খবর বৃহত্তর সমাজে পৌঁছে দেওয়া জরুরি। প্রতি বছরই শ্রমিক আন্দোলনের কোনও সংগ্রামীকে স্মরণ করে প্রতিষ্ঠা দিবস পালন করে এই মঞ্চ। এ বছর ২১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাল-অনুষ্ঠানে গৌতম সেন সম্পর্কে বললেন শুভেন্দু দাশগুপ্ত, ‘শতবর্ষে ট্রেড ইউনিয়ন ও জুট মিল’ নিয়ে শত্রুঘ্ন কাহার। ‘শ্রমিক শ্রেণি এখন’ বিষয়ে বললেন মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক নব দত্ত।
আঠেরোয়
‘রঙ্গপট’ নাট্যদল স্পর্শ করছে আঠেরো বছরের পৌঁছফলক। আওরঙ্গজেব, তথাগত, ধর্মাশোক, চতুষ্পাপ, কৃষ্ণপক্ষ, মেদেয়া— সমাদৃত বিবিধ প্রযোজনার ঐতিহ্যেই এ বার মঞ্চপ্রকাশ দু’টি নতুন অন্তরঙ্গ নাট্যের: দারিও ফো আশ্রিত মালিনী ভট্টাচার্যের নাটক, অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ভাবনা ও মধুরিমা গোস্বামীর নির্দেশনায় হপ্তা ছুট... অভিনয়ে সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়। এক মজুরানির দিনযাপনের যুদ্ধের সঙ্গে রাষ্ট্র-সমাজ-পরিবারের সমীকরণ। সঙ্গে কুন্তল মুখোপাধ্যায়ের আরও একটি নাটক, বিপ্লাণু মৈত্রের পরিচালনায় গন্ধরাজ, প্রকৃতিবিনাশের পশ্চাৎপটে সামাজিক-রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কাহিনি। ওই সন্ধ্যাতেই প্রকাশ পাবে তপনজ্যোতি দাস সম্পাদিত রঙ্গপট নাট্যপত্র, সৌমিত্র-শঙ্খ স্মরণসংখ্যা। ৬ অক্টোবর সন্ধে ছ’টায়, অ্যাকাডেমিতে।
রক্ষা পাক
৪০এ কাশী মিত্র ঘাট স্ট্রিট। এটাই বিখ্যাত শিল্পী ও ভাস্কর গোপেশ্বর পালের (১৮৯২-১৯৪৪) স্টুডিয়ো, ‘জি পাল অ্যান্ড সন্স’-এর ঠিকানা। ১৯২০-র দশকে বিদেশ ঘুরে শিল্পী কলকাতায় ফিরলেন, ঝুলিতে ইউরোপীয় শিল্পীদের কাজ দেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে। তা থেকেই স্কাইলাইট দিয়ে আসা প্রাকৃতিক আলোর ব্যবহারের মতো নানা অভিনবত্বে সাজিয়ে তুলেছিলেন আনুমানিক ১৯২৫-এ গড়া এই স্টুডিয়ো। দুর্গাপ্রতিমা নিয়ে প্রথাভাঙা কাজের পাশে মূর্তি তৈরিতেও খ্যাত এই স্টুডিয়ো, বেলুড় মঠের বিখ্যাত রামকৃষ্ণবিগ্রহ ছাড়াও বহু মনীষী, দেশনেতার মূর্তির জন্মস্থান (নীচের ছবিতে)। পুত্র সিদ্ধেশ্বর পাল পরে হাল ধরেন স্টুডিয়োর, এখন কর্ণধার সিদ্ধেশ্বরবাবুর স্ত্রী যমুনা পাল ও শ্যালক ব্যোমকেশ পাল। তবে ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত ওঁরা— ২০০৯ থেকেই কর্পোরেশনের হেরিটেজ তালিকায় থাকা এই স্টুডিয়োর সংস্কারে নিজেরা হাত দিতে পারেননি, প্রয়োজনীয় অনুমতির অভাবে। আমপানে ক্ষতি হয়েছে অনেক, ধসে পড়ার আশঙ্কায় শাল ও বাঁশের খুটি দিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে একটি দিক। নতুন করে ‘হেরিটেজ’ তকমার তোড়জোড় শুরুর পর রাজ্য হেরিটেজ কমিশনের পক্ষে পরিদর্শনও সারা। কিন্তু শর্তাবলি বা কমিশনের কোনও কাগজ মেলেনি এখনও। পুজোর প্রাক্কালে বাঙালির এই অমূল্য শিল্প-পরিসর কি একটু যত্ন ও মনোযোগ পেতে পারে না?
শিল্পরূপেণ
প্রতি বছর, পুজোর আগে আগে একটি ঠাকুর গড়েন হরিসাধন বিশ্বাস। একটিই। কখনও সপরিবারায় সবাহনায় দুর্গা, কখনও দুর্গা, সিংহ ও মহিষাসুর কেবল, এ বার যেমন। আকারে বারো ইঞ্চি। তবু একে ‘ঠাকুর গড়া’ বলতেই হয়, কারণ এই ‘গড়া’র পিছনেও আছে প্রমাণাকৃতি দুর্গাপ্রতিমা গড়ার ভাবনা থেকে ব্যাকরণ-প্রকরণ, সবই। বনহুগলির রাইমোহন ব্যানার্জি রোড-নিবাসী হরিসাধনবাবুর শিল্পকৃতির অভিনবত্ব, এক-এক বার এক-এক জিনিস দিয়ে ঠাকুর গড়া। এ বার বানিয়েছেন ট্যাবলেট-ক্যাপসুলের মোড়ক দিয়ে (উপরে ছবিতে)। প্রতিমা, সিংহ, মহিষাসুর, সবই তা-ই দিয়ে, এমনকি দুর্গার শাড়ি বা মহিষাসুরের পোশাক, সিংহের পিঠের রঙিন অলঙ্করণ, চালচিত্রও। মাস তিনেক ধরে, চল্লিশেরও বেশি বাছাই ওষুধের পাতা দিয়ে সযত্ন শ্রমে শেষ হয়েছে কাজ। প্রতি বছর তাঁর হাতে এ ভাবেই বিচিত্র আঙ্গিকে মূর্ত হচ্ছেন শিল্পরূপিণী।
ইচ্ছাপূরণ
দুয়ারে না হোক, দোরগোড়ায় ইলিশ! পুজোর মুখে বাংলাদেশ সরকারের উপহার, সাড়ে চার হাজার মেট্রিক টন পদ্মার ইলিশ পাঠানোর ঘোষণায় আনন্দঢাক জোর বেজেছে। দেবীপক্ষের পঞ্চমীর মধ্যে সব ইলিশ পৌঁছতেই হবে এ পারে, বলে দিয়েছে ঢাকা। শুনেও আনন্দ। তবে এ রুপোলি ফসল সাধারণের নাগালে থাকবে তো? না কি সৈয়দ মুজতবা আলী সাহেবের গল্পের মতো, গোয়ালন্দ স্টিমারে ইলিশের ঝোল-ভাতের দাম দিতে অক্ষম ক্রেতার জন্য ‘দেখনাই’ দর চালু হবে কলকাতার খাদ্যঠেকগুলিতে!