অগুনতি দুষ্কর্মে অভিযুক্তই সাক্ষীর কাঠগড়ায়!
বৃহস্পতিবার দুপুরে লোকটি সাক্ষ্য দিয়ে বেরোনোর সময়েই সন্দেহ হয়েছিল পুলিশের। আদালত থেকে কিছুটা দূরে পৌঁছতেই কামারহাটির বাসিন্দা, কুখ্যাত সমাজবিরোধী মহম্মদ আনোয়ারের দু’টি গাড়ির পথ আটকাল পুলিশ। গাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে পাওয়া গেল চার-চারটি আগ্নেয়াস্ত্র, ন’রাউন্ড গুলি, ধারালো অস্ত্রশস্ত্র। তার পরেই আনোয়ার এবং তার ১৯ জন সঙ্গীকে গ্রেফতার করল ব্যারাকপুরের পুলিশ। এ বার অবৈধ ভাবে অস্ত্রশস্ত্র রাখার অভিযোগ আনা হয়েছে আনোয়ারদের বিরুদ্ধে।
পুলিশের উপরে হামলা-সহ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে নানান অভিযোগের মধ্যেই রাজ্য পুলিশের আইজি (আইনশৃঙ্খলা) অনুজ শর্মা বুধবার হঠাৎ নবান্নে সাংবাদিক বৈঠক ডেকে পুলিশের অটুট মনোবলের বার্তা দিয়েছেন। তার প্রমাণ দিতে বিভিন্ন এলাকায় দুষ্কৃতীদের ধরপাকড় শুরু করেছে পুলিশ। বুধ ও বৃহস্পতিবার নিউ টাউনের তিন দুষ্কৃতী সমীর সর্দার ওরফে ভজাই, হায়দার আলি মোল্লা এবং রুইদাস মণ্ডল ওরফে রুইসকে অস্ত্র-সহ গ্রেফতার করা হয়েছে। কলকাতা, শহরতলি-সহ সর্বত্রই সিন্ডিকেটের যে-দৌরাত্ম্য নিয়ে মানুষের অভিযোগের অন্ত নেই, তার মোকাবিলায় কোমর বাঁধছে আইনরক্ষক বাহিনী। ওই তিন জনকে গারদে পুরে তার প্রমাণ দিয়েছে পুলিশ। আনোয়ার এবং তার সঙ্গীদের গ্রেফতার করে তারা সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে আরও একটু এগোল।
পুলিশ জানায়, একটি পুরনো মামলায় এ দিন সাক্ষ্য দিতে ব্যারাকপুর আদালতে যায় আনোয়ার। বিরোধী গোষ্ঠীর হাত থেকে বাঁচতে তার সঙ্গেই এসেছিল বাকিরা। আক্রমণ এড়াতে তারা সঙ্গে রেখেছিল অস্ত্রশস্ত্র। আদালতের কিছুটা দূরেই রাখা ছিল দু’টি গাড়ি। বেলা দেড়টা নাগাদ সাক্ষ্য দিয়ে বেরোনোর সময়েই পুলিশের সন্দেহ হয়। ব্যারাকপুরের রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ কলেজের সামনে সকলেই ধরা পড়ে যায়।
কে এই আনোয়ার?
পুলিশি সূত্রের খবর, যখন যারা সরকারে থাকে, তাল বুঝে তাদের দলে ভিড়ে যাওয়া অসংখ্য দুষ্কৃতীর এক জন হল আনোয়ার। বাম জমানায় কামারহাটির প্রভাবশালী এক সিপিএম নেতার ছত্রচ্ছায়ায় ছিল সে। কামারহাটি, বেলঘরিয়া, টিটাগড়, খড়দহ এলাকায় সিন্ডিকেট-ব্যবসা, ডাকাতি, খুন, তোলাবাজির মতো সব ধরনের দুষ্কর্মেই উঠে আসত এই দুষ্কৃতীর নাম। ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের বিভিন্ন থানায় তার নামে অজস্র অভিযোগ রয়েছে। রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরে রাতারাতি বাম শিবির ছেড়ে স্থানীয় বিধায়ক মদন মিত্রের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে আনোয়ার। নির্বাচন থেকে এলাকা দখল— সব কিছুতেই ছিল তার সক্রিয় ভূমিকা। পুলিশ জানাচ্ছে, পুরনো মামলা ছাড়া সাম্প্রতিক কালে কোনও অপরাধমূলক কাজে আনোয়ারের নামে অভিযোগ পাওয়া যায়নি। বরং ইদানীং সামাজিক কাজকর্মে তাকে যুক্ত থাকতে দেখা যাচ্ছিল বলে এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে জেনেছে পুলিশ।
তবে সেটা নিছক লোকদেখানো কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কারণ, পুলিশ জেনেছে, মধ্যমগ্রামের প্রোমোটার বাবু সেনের হত্যাকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত, ধৃত বাবু মণ্ডলের ‘গডফাদার’ ছিল এই আনোয়ারই। জমিবাড়ির কারবারিদের গোষ্ঠী-কাজিয়ার জেরেই বাবু সেনকে
ডেকে নিয়ে গিয়ে মধ্যমগ্রাম উড়ালপুলের উপরে গুলি করে মারা হয়। সেই ঘটনায় সরাসরি আনোয়ারের নাম ওঠেনি। তবে ওই হত্যকাণ্ডে মূল অভিযুক্ত বাবু মণ্ডল তারই শাগরেদ।
এই সূত্রে সিন্ডিকেট-কাজিয়া এবং তার সঙ্গে আনোয়ারের ওতপ্রোত যোগাযোগের বৃত্তান্তও উঠে আসছে। আসলে বি টি রোডের ধারে তৈরি প্রতিটি আবাসনেই আনোয়ারের সিন্ডিকেটের ভূমিকা রয়েছে বলে জানাচ্ছে পুলিশ। ব্যারাকপুরের পুলিশ কমিশনার নীরজ সিংহ অবশ্য বলেন, ‘‘ইদানীং আনোয়ারের বিরুদ্ধে তেমন কোনও অভিযোগ ওঠেনি। এ দিন তাকে এবং তার শাগরেদদের গ্রেফতার করা হয়েছে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি করার অভিযোগে।’’