তুলিকাদেবীর সঙ্গে সার্থক।
বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলা যানবাহনে রাশ না টানলে তার পরিণতি যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে, ফের তার প্রমাণ মিলল। মঙ্গলবার বিকেলে উত্তর শহরতলির বিটি রোডে এমনই এক বেপরোয়া লরি একই সঙ্গে কেড়ে নিল মা ও ছেলের প্রাণ। ঘটনার প্রতিবাদে প্রতিবারের মতো এ বারও স্থানীয় লোকজন রাস্তা অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখালেন। তাঁদের শান্ত করতে পুলিশ প্রশাসন ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাসও দিলেন বটে, কিন্তু তা যে আদৌ কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে অবশ্য সংশয় থেকেই গেল স্থানীয়দের মনে।
পুলিশ সূত্রে খবর, কোন্নগরের দেবপাড়ার বাসিন্দা পেশায় রেলকর্মী শৌভিক মিত্রের ছেলে সার্থক মিত্র (১১) সোদপুর সুখচরের একটি বেসরকারি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। প্রতিদিনই কোন্নগর থেকে নৌকো করে সোদপুরের স্কুলে যাতায়াত করত সে। জাতীয় স্তরের সাঁতারু সার্থকের এ দিন বিকেলে বালি গ্রামাঞ্চল সুইমিং সেন্টারে প্রশিক্ষণ ছিল। তাই স্কুল ছুটির পরে ছেলেকে সেখানে নিয়ে যাওয়ার জন্য মা তুলিকাদেবী (৩৫) স্কুটি নিয়ে কোন্নগর থেকে পৌঁছে গিয়েছিলেন সোদপুরে। ছুটির পরে ছেলেকে স্কুটির পিছনে বসিয়ে বালির সাঁতার প্রশিক্ষণ-কেন্দ্রে যাচ্ছিলেন তিনি।
স্থানীয় একটি সূত্রে খবর, তুলিকাদেবী স্কুটি নিয়ে বিটি রোডের ডান দিক ঘেঁষেই যাচ্ছিলেন। পিছনে বেপরোয়া গতিতে ছুটে আসছিল দু’টি লরি। আগরপাড়া মোল্লারহাট এলাকায় আচমকাই একটি লরি তীব্র গতিতে এগিয়ে গিয়ে স্কুটির সামনে চলে আসে। স্কুটির পিছনে ততক্ষণে তীব্র গতিতে ছুটে চলে এসেছে অন্য লরিটিও। প্রত্যক্ষদর্শীদের একাংশ জানান, ওই লরিটি আরও গতি বাড়িয়ে সামনের লরিটিকে ওভারটেক করার জন্য এগোতেই ঘটে বিপত্তি। দু’টি লরির মাঝে পড়ে হকচকিয়ে যান তুলিকাদেবী। এরই মধ্যে পিছনের লরির ধাক্কায় স্কুটিটি প্রথমে সামনের লরিতে ধাক্কা মারে এবং তার পরে রাস্তার ধারের ডিভাইডারে ধাক্কা মেরে উল্টে যায়। রাস্তায় ছিটকে পড়েন মা ও ছেলে। দু’জনের মাথাতেই হেলমেট ছিল। পুলিশকর্তাদের দাবি, রেষারেষি না পিছন থেকে আসা বেপরোয়া লরির ধাক্কায় দুর্ঘটনা, তা এখনও স্পষ্ট নয়।
এ দিকে, রাস্তার উপরে মা ও ছেলেকে ছিটকে পড়তে দেখে বেপরোয়া গতিতে ছুটে চলা একটি লরিকে তেঁতুলতলার কাছে আটক করে ট্র্যাফিক পুলিশ। তবে সেই লরিতেই ধাক্কা লেগেছিল কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে বলেই জানান ব্যারাকপুর পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি (জোন ২) ধ্রুবজ্যোতি দে। তুলিকাদেবী ও সার্থককে স্থানীয় লোকজন ও পুলিশকর্মীরা সাগর দত্ত হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসকেরা দু’জনকেই মৃত বলে ঘোষণা করেন। প্রাথমিক ভাবে চিকিৎসকদের মনে হয়েছে তুলিকাদেবীর মাথায় এবং সার্থকের পেটে আঘাত লেগেছিল।
এ দিন মোল্লারহাট এলাকায় এই দুর্ঘটনার পরেই বিক্ষোভ শুরু করেন স্থানীয়েরা। তাঁদের অভিযোগ, এই ঘটনা প্রথম নয়, এর আগেও বহুবার বেপরোয়া যানবাহনের ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে গাড়ি-চালক, পথচারীদের। প্রতিবারই ওই এলাকায় ট্র্যাফিক সিগন্যালের জন্য দাবি জানিয়ে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয়েরা। এ দিনও ফের একই দাবিতে প্রায় এক ঘণ্টা বিটি রোড অবরোধ করে বিক্ষোভ দেখান স্থানীয়েরা। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে যান খড়দহ থানার বিশাল পুলিশ বাহিনী ও স্থানীয় কাউন্সিলর, নেতারা। আসেন ব্যারাকপুরের ডেপুটি কমিশনার (ট্র্যাফিক) অবধেশ পাঠক। পরে বিক্ষোভকারীদের বুঝিয়ে অবরোধ তুলে রাস্তা চালু করা হয়। তবে এ দিন সমস্যার কথা স্বীকার করে অওধেশবাবু বলেন, ‘‘ওই জায়গায় সিগন্যালের জন্য আগেও পূর্ত দফতর ও পুরসভার সঙ্গে কথা হয়েছে। এ দিনও কথা হয়েছে। দেখছি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা করা যায়।’’
এ দিন দুর্ঘটনার পরে সার্থকের সাঁতার প্রশিক্ষণ সেন্টারের পরিচয় পত্র দেখে প্রশিক্ষককে ফোন করে খবর দেয় পুলিশ। সেখান থেকেই জানানো হয় তাদের বাড়িতে। পর পর দু’বার সাব জুনিয়র বিভাগে জাতীয় স্তরের সাঁতারে অংশগ্রহণকারী সার্থক ও তার মায়ের মৃত্যুতে দেবপাড়ায় শোকের ছায়া নেমে আসে। সার্থকের সাঁতারের হাতেখড়ি কোন্নগর সুইমিং ক্লাবে। ২০১৫ সালে জাতীয় সাঁতারে পুনেতে অংশ নেয়। এই বছর বেঙ্গালুরুতেও জাতীয় সাঁতারে সে বাংলার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করে। কোন্নগরে দেবপাড়ায় শৌভিকবাবুদের প্রতিবেশী সুরজিৎ ঘোষ বলেন, ‘‘বিকেলে দুর্ঘটনার খবর পেয়ে আমরা হতবাক। সেই সময়ে আমি বালিতে মেয়েকে সাঁতার শেখাতে নিয়ে গিয়েছিলাম। হাসপাতালে পৌঁছে দেখি সব শেষ।’’