—প্রতীকী চিত্র।
পর পর দু’বার ফোন বেজেছে, কিন্তু কোনও বারই উত্তর মেলেনি। ফের ফোন করে এক বয়স্ক কণ্ঠস্বর শুধু জানিয়েছেন নিজের নাম আর বয়স। কিন্তু কেন ফোন করছেন, বলতে পারেননি। কিছু দিন পরেই রাস্তা থেকে কলকাতা পুলিশ উদ্ধার করে ওই নামের, ওই বয়সেরই এক বৃদ্ধকে। কিছুতেই বাড়ি ফিরতে চাননি বছর সত্তরের বৃদ্ধ। পুলিশের উদ্যোগে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের হোমে রেখে চিকিৎসা হয় তাঁর। জানা যায়, ডিমেনশিয়ায় (স্মৃতিভ্রংশের সমস্যা) ভুগছেন তিনি। পুলিশ খুঁজে বার করে ওই বৃদ্ধের বাড়ি। জানা যায়, ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত বৃদ্ধকে দিনের পর দিন একটি ঘরে আটকে রাখতেন পুত্র এবং পুত্রবধূ। পান থেকে চুন খসলেই জুটত আরও নির্যাতন। পুলিশে এক দিন ফোনও করে ফেলেছিলেন বৃদ্ধ। কিন্তু নাম আর বয়স বলার পরে বাকিটা বলার জন্য স্মৃতি সঙ্গ দেয়নি! শেষ পর্যন্ত এক দিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াই ঠিক মনে করেছিলেন তিনি।
লালবাজারের কমিউনিটি পুলিসিং বিভাগের এক আধিকারিক বৃদ্ধের এই ঘটনা জানিয়েই বুধবার বললেন, ‘‘এমন প্রচুর উদাহরণ রয়েছে। সব জায়গায় পৌঁছে পরিষেবা দেওয়া যায় না। প্রবীণদের উপরে হওয়া বেশির ভাগ নির্যাতনই পুলিশ পর্যন্ত পৌঁছয় না। বয়স্কেরা তাঁদের অধিকার সম্পর্কে জানেন না, সাধারণ মানুষও তেমন সচেতন নন।’’ আজ, বৃহস্পতিবার ‘ওয়ার্ল্ড এল্ডার অ্যাবিউজ় অ্যাওয়ারনেস ডে’ বা বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবসে এটাই সব চেয়ে বড় চিন্তার বিষয় বলে মত তাঁর।
এই প্রসঙ্গেই উঠে আসছে এ বিষয়ে একাধিক সমীক্ষার কথা। কলকাতা পুলিশের কমিউনিটি পুলিসিং বিভাগই দেখেছে, প্রতি সাত জন প্রবীণের মধ্যে অন্তত তিন জন নির্যাতনের শিকার। ৩২ শতাংশ আত্মীয়দের দ্বারা, ২১ শতাংশ বন্ধু বা দেখাশোনার দায়িত্বপ্রাপ্তের দ্বারা এবং ২০ শতাংশ প্রতিবেশীর দ্বারা নির্যাতনের শিকার। বাকিরা সরাসরি সন্তান এবং সন্তানদের সঙ্গীদের হাতে নির্যাতিত।
দেখা যাচ্ছে, যে সমস্ত প্রবীণ একা থাকেন ( ৮.২ শতাংশ) এবং যাঁরা সন্তানদের সঙ্গে থাকলেও জীবনসঙ্গীকে হারিয়েছেন (৫.৪ শতাংশ), তাঁদের উপরে নির্যাতন হওয়ার ঘটনা বেশি। কলকাতা পুলিশের এক কর্তা জানাচ্ছেন, ‘ইউএন পপুলেশন প্রসপেক্টস’ অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতের ২০ শতাংশ জনসংখ্যার বয়স ৬০ বছর বা তার উপরে গিয়ে দাঁড়াবে। সেই সঙ্গেই বাড়তে পারে ডিমেনশিয়ার মতো রোগে আক্রান্তের সংখ্যা। ওই পুলিশকর্তার কথায়, ‘‘তথ্য বলছে, ২০১৫ সালে ভারতে ৩০ লক্ষ মানুষ ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন। এখন তা ৮০ লক্ষে পৌঁছেছে। ২০২৫ সালের মধ্যে সংখ্যাটা ২০০ শতাংশ বেড়ে যেতে পারে। অর্থনৈতিক দিক থেকে নিশ্চয়তা দিতে ‘দ্য মেনটেনেন্স অ্যান্ড ওয়েলফেয়ার অব পেরেন্টস অ্যান্ড সিনিয়র সিটিজ়েনস ল, ২০০৭’ পাশ হয়েছে। এতে যে কোনও প্রবীণের ভরণপোষণের দিকটা কিছুটা নিশ্চিত হলেও নির্যাতনের নানা রূপ রয়েছে।’’
পুলিশ জানাচ্ছে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, প্রবীণেরা নির্যাতিত হতে পারেন শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক ভাবে। যুক্ত হতে পারে যৌন নির্যাতনও। কলকাতা পুলিশের যুগ্ম-নগরপাল পদমর্যাদার এক অফিসার বললেন, ‘‘শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের ব্যাপারে তেমন ধোঁয়াশা নেই। কিন্তু দোষ দেওয়া, হুমকি দেওয়া, বকাঝকা করা, অপমান করা, দিনের পর দিন অবহেলা করার মতো বিষয়কে আবেগে আঘাতের দিক থেকে যে দেখা হয়, অনেকেই জানেন না। এর সূত্রেই আসে মানসিক নির্যাতনের প্রসঙ্গ। পাশাপাশি, সম্পত্তি চুরি, এটিএম ও ক্রেডিট কার্ড, পাসবইয়ের অপব্যবহার, জোর করে ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’র হাতবদল অর্থনৈতিক নির্যাতনের মধ্যে পড়ে। আর একটি নির্যাতন হল, অসুস্থতাকে গুরুত্ব না দেওয়া। এমনও হতে পারে, দিনের পর দিন না দেখার দরুণ কোনও প্রবীণের বেডসোর হয়ে গেল! সেটাও কিন্তু চাইলে আইনের পথে টেনে এনে ব্যবস্থা নেওয়া যায়।’’
ভারত সরকারের রিজিয়োনাল রিসোর্স অ্যান্ড ট্রেনিং সেন্টার, ‘কলকাতা মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউট অব জেরন্টোলজি’র প্রতিষ্ঠাতা ইন্দ্রাণী চক্রবর্তী যদিও বললেন, ‘‘ব্যবস্থা তো অনেক কিছুই করা যায়। কিন্তু এমন বহু মায়েদের আমি দেখেছি, যাঁরা বাড়িতে মার খাচ্ছেন, অথচ পুলিশে একটি কথাও বলবেন না! অভিযোগ করলেই পুলিশ নাকি ছেলেকে তুলে এনে পেটাবে! সমাজের যেখানে এই অবস্থা, সেখানে সব স্তরে সচেতনতার প্রচার ছাড়া অন্য উপায় নেই।’’