পরিযায়ী ‘ব্রাউন ব্রেস্টেড ফ্লাইং ক্যাচার’। সুদীপ ঘোষের তোলা ছবি।
গত বছর ছট পুজোর আগে রবীন্দ্র সরোবরে দেখা গিয়েছিল কয়েকটি ‘হোয়াইট টেল্ড রবিন’। চমকে উঠেছিলেন প্রাতর্ভ্রমণকারীরা। শহরে তো এদের দেখা যায় না! জানা গিয়েছিল, শীতের মুখে পাহাড়ি এলাকা থেকে উড়ে মহানগরে এসে সরোবরে ঘাঁটি গেড়েছিল ওরা।
অথচ ছট পুজোর বিসর্জন পেরোতেই লেক থেকে উধাও হয়ে গিয়েছিল ওই ‘অতিথিরা’! গত বছর ছট পুজোর আগে লেকে গিয়ে ওই অতিথিদের ছবি তুলেছিলেন পক্ষী বিশারদ শান্তনু মান্না। তাঁর কথায়, ‘‘ছটপুজোর বিসর্জনে লেক এলাকায় দেদার বাজি ফাটে। তাতে আতঙ্কিত হয়েই হয়তো এলাকা ছেড়ে পালিয়েছিল ওরা।’’ এ বার সেই আশঙ্কা রয়েছে কালীপুজো ঘিরেও।
পক্ষীপ্রেমীরা বলছেন, গত কয়েক বছর ধরেই শীতের শুরু থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত নানা ধরনের পরিযায়ী পাখি অতিথি হয়ে আসছে এ শহরে। যেখানে জল রয়েছে, সে সব জায়গাকেই প্রধানত বেছে নেয় তারা। রবীন্দ্র সরোবর ছাড়াও ইকো পার্ক, রাজারহাট সংলগ্ন ভেড়ি, সাঁতরাগাছি এলাকায় ইতিউতি দেখা যায় তাদের। কয়েক দিন আগেই রবীন্দ্র সরোবরে ঝোপের মধ্যে থেকে পাখির ডাক শুনে দাঁড়িয়ে গিয়েছিলেন কয়েক জন প্রাতর্ভ্রমণকারী। কাছে গিয়ে দেখেন, ঝোপের ভিতরে অচেনা নীল রঙের পাখি বসে রয়েছে! খবর পেয়ে হাজির হন পক্ষীপ্রেমীদের অনেকেই। ছবি তোলার পরে জানা যায় নীল রঙের ওই পাখিটির নাম ‘সাইবেরিয়ান ব্লু রবিন’। পরিযায়ী এই পাখি এর আগে রবীন্দ্র সরোবর এলাকায় দেখা যায়নি বলে দাবি করেছেন পক্ষীপ্রেমীরা।
লেক এলাকার পাখিদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন পরিবেশপ্রেমী ও পক্ষীবিশারদেরা বলছেন, সরোবরে ইদানীং দেখা যাচ্ছে, জাপান, কোরিয়ার বাসিন্দা ‘এশিয়ান স্টাবটেল’, মধ্য চিনের ‘ফায়ারথ্রোট’-এর মতো পরিযায়ী পাখিদেরও। গত বছরের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে কয়েকটি সরালকেও লেকের জলে ভাসতে দেখা গিয়েছিল। গত কয়েক বছরের নিরিখে বাড়ছে ‘ব্লু থ্রোটেড ফ্লাইক্যাচার’ এবং ‘ব্রাউন ব্রেস্টেড ফ্লাই ক্যাচার’ প্রজাতির পাখিও।
কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, শহরে এলেও অতিথিরা কিন্তু নিশ্চিন্তে থাকতে পারছে না। পরিবেশপ্রেমীরা বলছেন, এমনিতে শহরে দূষণ বেশি। তার উপরে কালী ও ছট পুজোর বিসর্জন এবং বাজি পোড়ানোর ফলে পরিযায়ী পাখিদের সমস্যা হচ্ছে। লেকে ছট পুজোর তেল, ফুল পড়ায় জল দূষিত হচ্ছে। ফলে জলে থাকা পাখিরাও বিপন্ন হতে পারে
বলে আশঙ্কা করছেন তাঁরা। দূষণ ঠেকাতে ইতিমধ্যেই রবীন্দ্র সরোবরের দায়িত্বে থাকা কেআইটি-কে চিঠিও লিখেছেন পরিবেশপ্রেমী ও পক্ষীবিশারদদের অনেকে।
পক্ষীবিশারদদের অনেকে বলছেন, সরালের মতো পাখিরা জলে থাকে। কিন্তু জলের মাঝে বা পাড়ের কোনও জায়গায় ওদের বাসা তৈরি এবং বিশ্রামের জায়গার প্রয়োজন হয়। এ ধরনের পাখিদের উপরে চোরাশিকারিদেরও নজর থাকে। ফলে সেই বিপদ থেকেও এদের রক্ষা করা প্রয়োজন। এ দিকে, জলে অতিরিক্ত শ্যাওলা বা ময়লা জমলেও তার প্রকোপ পাখিদের উপরে পড়ে। তাতে এক দিকে জলে যেমন খাবারের সঙ্কটে পড়ে ওরা, তেমনই আক্রান্ত হয় নানা রোগে। গত বছরের শীতে এই দূষণের প্রকোপেই সাঁতরাগাছি ঝিলে প্রচুর পরিযায়ী পাখির মৃত্যু হয়েছিল।
পক্ষীপ্রেমী সংস্থা ‘বার্ডস অব রবীন্দ্র সরোবর’-এর সদস্য সুদীপ ঘোষ জানান, শীত পড়ার মুখে পরিযায়ী পাখিরা কোথাও একটি নির্দিষ্ট সময় ধরে আশ্রয় নেয়। কোথাও বা আবার যাতায়াতের পথে ক্লান্ত হয়ে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেয়। কোন জায়গায় কতক্ষণ থাকবে তা ওই এলাকার পরিবেশের উপরে নির্ভর করে। ‘‘রবীন্দ্র সরোবরে যে ভাবে দূষণের অভিযোগ উঠছে তাতে এটি পাখিদের জন্য কতটা উপযুক্ত তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়,’’ মন্তব্য সুদীপবাবুর।
তিনি জানান, পাখিদের থাকার জন্য ঝোপঝাড় এবং জল দূষণ রোধে ব্যবস্থা নিতে ইতিমধ্যেই কেআইটি কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। রবীন্দ্র সরোবর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য কলকাতা হাইকোর্ট নিযুক্ত কমিটির অন্যতম সদস্য সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘‘সরোবরে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে চড়া আলো ব্যবহার করা হচ্ছে। এ ধরনের আলো পাখিদের জন্য ক্ষতিকর। কেআইটি কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে জানানো হলেও কোনও লাভ হয়নি।’’
বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আলো ব্যবহার নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে রাজি হননি কেআইটি কর্তৃপক্ষ। তবে রবীন্দ্র সরোবরের ভারপ্রাপ্ত কেআইটির বাস্তুকার সুধীন নন্দী বলেন, ‘‘সরোবরের মধ্যে থাকা কৃত্রিম দ্বীপগুলি, সাফারি পার্ক এবং লিলিপুলে পাখিদের আকৃষ্ট করার জন্য ব্যবস্থা করা হবে। সরোবরের জল যাতে দূযণমুক্ত থাকে, সে ব্যাপারেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’’