তোড়জোড়: দক্ষিণেশ্বর মেট্রো স্টেশন তৈরির কাজ চলছে পুরোদমে। ছবি: সজল চট্টোপাধ্যায়
সব ঠিকমতো চললে বছর দেড়েকের মধ্যেই মেট্রো চালু হওয়ার কথা নোয়াপাড়া ও দক্ষিণেশ্বরের মধ্যে। কিন্তু তার আগে দক্ষিণেশ্বর স্টেশন থেকে নির্বিঘ্নে ট্রেন চালানো নিয়ে রীতিমতো সংশয়ে খোদ মেট্রোকর্তাদেরই একাংশ।
তাঁদের মতে, ওই স্টেশনের অবস্থা কার্যত শাঁখের করাতের মতো। পরিস্থিতি এমনই যে, অল্প বা বেশি সময়ের ব্যবধান, যে ভাবেই মেট্রো চালানো হোক না কেন, যাত্রীদের ভোগান্তি এক রকম নিশ্চিত। যার ফলে মেট্রো চালু হলেই যাত্রীদের ক্ষোভ সামাল দিতে চাপ বাড়বে মেট্রোকর্মীদের উপরে।
কী ধরনের সমস্যায় পড়তে হতে পারে যাত্রীদের?
মেট্রোকর্তাদের একাংশের মতে, ভিড়ের চাপ সামাল দিতে দক্ষিণেশ্বর মেট্রো স্টেশন থেকে অল্প সময়ের ব্যবধানে ট্রেন চালাতে গেলে আপ এবং ডাউন, দু’টি প্ল্যাটফর্ম থেকে একই অভিমুখে ট্রেন ছাড়তে হবে। তিন-চার মিনিটের ব্যবধানে ওই ভাবে ট্রেন চালাতে গেলে মুখোমুখি থাকা দুই প্ল্যাটফর্মের যাত্রীদের মধ্যে চরম বিভ্রান্তি তৈরি হবে। এক প্ল্যাটফর্ম থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে অন্য প্ল্যাটফর্মে যাওয়ার সময়ে হুড়োহুড়ির মধ্যে পড়ে দুর্ঘটনা ঘটাও অস্বাভাবিক নয়।
আবার তাড়াহুড়ো এড়াতে দু’টি মেট্রোর ব্যবধান বাড়িয়ে দিলে আপ প্ল্যাটফর্ম কার্যত অব্যবহৃতই থেকে যাবে। যাত্রীদের ওঠা-নামা সবই চলবে ডাউন প্ল্যাটফর্ম (নোয়াপাড়ামুখী) থেকে। পুজো বা কোনও উৎসবের সময়ে দক্ষিণেশ্বরে যাত্রীদের আনাগোনা বাড়লে যে পরিস্থিতি তৈরি হবে, তাতে একটি প্ল্যাটফর্ম থেকে ওই চাপ সামাল দেওয়া কার্যত অসম্ভব।
এখন প্রশ্ন উঠেছে, প্রায় সম্পূর্ণ হতে চলা মেট্রোপথের পরিকল্পনায় এমন গলদ রয়ে গেল কেন?
মেট্রো সূত্রের খবর, ট্রেনকে ফিরতি পথে চালাতে গেলে এক লাইন থেকে অন্য লাইনে নিয়ে যাওয়ার সুষ্ঠু ব্যবস্থা থাকা জরুরি। এই ব্যবস্থাকে ‘ক্রসওভার’ বলে। রোমান ‘এক্স’ অক্ষরের মতো লাইন দিয়ে দু’টি পথ জোড়া থাকে।
আদর্শ ব্যবস্থায় ‘ক্রসওভার’ থাকে নির্দিষ্ট স্টেশন অতিক্রম করার পরে আরও অন্তত ২০০-২৫০ মিটার দূরে।
কিন্তু দক্ষিণেশ্বর মেট্রো স্টেশনের সামনে মন্দিরের দিকে স্কাইওয়াক তৈরি হওয়ায় ওই অংশে জমি মেলেনি। ফলে মেট্রোর লাইন বদলের জন্য ‘ক্রসওভার’ তৈরি করতে হয়েছে বরাহনগরের দিকে। অর্থাৎ, যাত্রী ভর্তি মেট্রো দক্ষিণেশ্বর স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পৌঁছনোর আগেই তাকে প্রান্ত বদলের কাজ সেরে ফেলতে হবে। অন্যথায় সোজা আপ প্ল্যাটফর্মে পৌঁছে যাত্রী নামালে ফের ওই প্ল্যাটফর্ম থেকেই যাত্রী তুলতে হবে। পরে পিছিয়ে পাশের ডাউন লাইনে আসার জন্য অপেক্ষা করতে হবে ওই লাইন খালি পাওয়ার জন্য।
ওই সময়ে আপ লাইন দিয়ে কোনও ট্রেন এলে তাকে বরাহনগর এবং দক্ষিণেশ্বরের মাঝে অপেক্ষা করতে হবে প্ল্যাটফর্ম খালি পাওয়ার জন্য। ফলে প্রক্রিয়াটি জটিল এবং বিলম্বিত হবে। ভিড়ের সময়ে অল্প সময়ের ব্যবধানে দু’টি প্ল্যাটফর্ম থেকেই নোয়াপাড়ামুখী ট্রেন ছাড়তে গেলে যাত্রীদের বিভ্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও প্রবল। আবার ছ’-সাত মিনিট বা তার বেশি ব্যবধানে দক্ষিণেশ্বর থেকে নোয়াপাড়ার দিকে ট্রেন চালালে দক্ষিণেশ্বর রেল স্টেশনের গা ঘেঁষে তৈরি হওয়া আপ প্ল্যাটফর্মটির কার্যত প্রয়োজনই থাকে না।
কিন্তু যাত্রী-সংখ্যা বাড়লে একটিমাত্র প্ল্যাটফর্ম থেকে যাত্রীদের ওঠানামা কতটা সমর্থনযোগ্য, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
মেট্রো রেলের মুখ্য জনসংযোগ আধিকারিক ইন্দ্রাণী বন্দ্যোপাধ্যায়ের অবশ্য দাবি, “দক্ষিণেশ্বর প্রান্তিক স্টেশন। তাই যাত্রীরা কয়েক মিনিটের ব্যবধানে দু’টি প্ল্যাটফর্মের যে কোনওটি থেকে ট্রেন ধরতে পারবেন। ঘনঘন ট্রেন চালালেও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।”
মেট্রোর এক কর্তার মতে, পরিকল্পনার ত্রুটি দু’ভাবে এড়ানো যেত। প্রথমত, দক্ষিণেশ্বর মেট্রো স্টেশনের ডান দিকে রেলের পরিত্যক্ত আবাসনের জমি রয়েছে। মেট্রোপথ ওই দিকে সম্প্রসারিত করলে একেবারে নিয়ম মেনে ‘ক্রসওভার’ তৈরি করা যেত । এখন যা রয়েছে, তা আপৎকালীন ব্যবস্থা।
দ্বিতীয়ত, প্রান্তিক স্টেশনে দু’টি প্ল্যাটফর্মের মাঝে একটি ‘আইল্যান্ড’ তৈরি করলে যাত্রীরা যে কোনও ট্রেনের দু’দিক দিয়েই ওঠা-নামা (ডবল ডিসচার্জ) করার সুযোগ পেতেন। সে ক্ষেত্রে বিভ্রান্তি কমার পাশাপাশি তাড়াহুড়ো থেকে দুর্ঘটনাও এড়ানো যেত। এ নিয়ে জানতে চাওয়া হলে রেল বিকাশ নিগম লিমিটেডের কর্তারা কোনও মন্তব্য করতে চাননি। এক কর্তা জানান, মেট্রো কর্তৃপক্ষ নকশা অনুমোদনের পরেই কাজ শুরু হয়েছে।