হাসপাতাল নয়, থানার দ্বারস্থ মনোরোগীর পরিবার

খালি গায়ে গামছা জড়ানো। দুপুর রোদে ঘরের সামনের রাস্তায় বসে কাচের বয়ামে ভরা জলের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে তিনি বলে ওঠেন, ‘‘এখানে মাছ চাষ হচ্ছে।’’ কয়েক মিনিট থেমেই তাঁর দাবি, ‘‘মাছ চাষে যে আটকাবে, সে-ই মার খাবে। ভাইঝিও মার খেয়েছে।’’

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০১৯ ০২:১২
Share:

বিপত্তি: এই জায়গাতেই ভাইঝিকে ছুড়ে ফেলার অভিযোগ উঠেছে সুমনের বিরুদ্ধে। ছবি: রণজিৎ নন্দী

নেড়া হওয়া মাথায় হাল্কা চুল গজিয়েছে। খালি গায়ে গামছা জড়ানো। দুপুর রোদে ঘরের সামনের রাস্তায় বসে কাচের বয়ামে ভরা জলের দিকে এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে তিনি বলে ওঠেন, ‘‘এখানে মাছ চাষ হচ্ছে।’’ কয়েক মিনিট থেমেই তাঁর দাবি, ‘‘মাছ চাষে যে আটকাবে, সে-ই মার খাবে। ভাইঝিও মার খেয়েছে।’’
জলাধারের জন্য খোঁড়া প্রায় ১০ ফুট গভীর একটি গর্তের দিকে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমি মাছ ধরছিলাম। ভাইঝি এসে জ্বালাচ্ছিল। দিয়েছি ওখানে ছুড়ে! ওইটুকু মেয়ে আমার সঙ্গে ঝগড়া করতে আসে!’’ পরিবারের দাবি, ওই যুবক মানসিক ভারসাম্যহীন।
সুমন মিস্ত্রি নামে বছর পঁয়ত্রিশের ওই যুবককে নিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন ৩৪, বাগমারি রোডের বাসিন্দারা। তাঁদের দাবি, মাথা গরম হলে যখন তখন, যাঁকে তাঁকে ছুরি নিয়ে মারতে যাচ্ছেন সুমন। বাদ যায় না শিশুরাও। দিন কয়েক আগে এক শিশুর চোখে কাঠি ঢুকিয়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছিল তাঁর বিরুদ্ধে। পরিস্থিতি আরও ঘোরালো হয়ে ওঠে গত বুধবার। নিজের ন’বছরের ভাইঝিকেই ছুড়ে ফেলে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। যেখানে শিশুটিকে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল, সেই নির্মীয়মাণ জলাধারের গর্তে লোহার শিক বেরিয়ে রয়েছে। তার একটি শিশুটির গায়ে ঢুকলে বিপদ বাড়ত বলেই মত প্রত্যক্ষদর্শীদের।
এর পরেই সুমনের বিরুদ্ধে মানিকতলা থানায় গিয়ে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন তাঁর ভাই সুষেণ। কিন্তু, মানসিক ভারসাম্যহীন রোগীকে চিকিৎসা করানোর বদলে থানায় অভিযোগ করার কারণ কী? সুষেণের বক্তব্য, ‘‘দাদাকে নিয়ে আর পারছি না। ওকে হাসপাতালে পাঠানোর ক্ষমতা আমাদের নেই।’’
বাগমারি রোডের ওই এলাকায় গিয়ে জানা গেল, আগে রেললাইনের ধারের ঝুপড়িতে থাকতেন সুমনেরা। বিয়ের পরে সরকারের তৈরি করে দেওয়া আবাসনে পরিবার নিয়ে উঠে গিয়েছেন তাঁর ছোট ভাই সুষেণ এবং দাদা সুভাষ। সুষেণের সঙ্গেই থাকেন তাঁদের মা। তবে সেই ঘরে সুমনের জায়গা হয়নি। স্ত্রী-পুত্র, কন্যাদের নিয়ে আবাসন লাগোয়া ঝুপড়িতেই থাকছিলেন তিনি। তবে মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সন্তানদের নিয়ে অন্যত্র চলে গিয়েছেন স্ত্রী। এখন ঝুপড়ির ঘরে একাই থাকেন সুমন। সুভাষের দাবি, ‘‘মাথায় চোট পাওয়ার পর থেকেই অসুস্থ সুমন। গ্রিন পুলিশে চাকরি পেয়েছিল, করতে পারল না। আমরা ওকে কয়েক বার হাসপাতালে দেখিয়েছি। সুস্থ হয়ে ফেরার পরেই আবার ও রকম শুরু করে। এখন বললেও হাসপাতালে যায় না। তাই পুলিশের দ্বারস্থ হয়েছি।’’
সুভাষদের প্রতিবেশী মনিকা সর্দার নামে এক মহিলার আবার অভিযোগ, ‘‘আগে এই সমস্যা নিয়ে বহু বার থানায় জানানো হয়েছে। তখন কিছুই করেনি। বাচ্চাটাকে ছুড়ে ফেলার পরে পুলিশের হুঁশ হয়েছে।’’ সুভাষ বললেন, ‘‘পুলিশ আগে সাহায্য করলে এ সব হত না।’’
এ বিষয়ে মানিকতলা থানায় যোগাযোগ করা হলে দায়িত্বপ্রাপ্ত পুলিশ আধিকারিক বলেন, ‘‘ওই যুবকের পরিবার এবং প্রতিবেশীদের সই-সহ একটি অভিযোগপত্র জমা পড়েছে। তার ভিত্তিতেই আদালতে আবেদন করব। আদালত নির্দেশ দিলে সরকারি মানসিক হাসপাতালে রেখে যুবকের চিকিৎসা করানো হবে।’’ কিন্তু, সমস্যা তো দীর্ঘদিনের? ওই পুলিশ আধিকারিকের কথায়, ‘‘আগে সে রকম গুরুতর অভিযোগ ছিল না।’’
কোনও মানসিক রোগীকে নিয়ে সমস্যার কথা জানালে পুলিশের কি অভিযোগের জন্য অপেক্ষা করা উচিত? লালবাজারের কর্তারা বলছেন, ‘‘পুলিশ এ সব ক্ষেত্রে নিজেই ব্যবস্থা নিতে পারে। এ ক্ষেত্রে কী হয়েছে খোঁজ নিয়ে দেখা হবে।’’ মনোরোগীদের নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলির বক্তব্য, মানসিক রোগ নিয়ে সামাজিক সচেতনতা যে এখনও তলানিতে এ ঘটনা তারই প্রমাণ। মানসিক রোগীদের জন্য থানা নয়, চিকিৎসা জরুরি, আশপাশের মানুষের সহানুভূতি জরুরি। এটা সবাইকে বুঝতে হবে।
আর যাকে কাকা ছুড়ে ফেলেছিলেন, লাবণি নামের সেই বালিকা বলছে, ‘‘কাকা সুস্থ হয়ে ফিরুক, একসঙ্গে খেলা করব।’’

Advertisement

এবার শুধু খবর পড়া নয়, খবর দেখাও।সাবস্ক্রাইব করুনআমাদেরYouTube Channel - এ।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement