একের পর এক হাসপাতালে ধাক্কা খেয়ে বেড়াচ্ছে অসুস্থ শিশুরা।
চার বছর আগে ‘মানবিক’ সিদ্ধান্ত নিয়ে ১৬ শয্যার পেডিয়াট্রিক অঙ্কোলজি ইউনিট শুরু করেছিল নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল (এনআরএস)। তার জন্য স্বাস্থ্য দফতরের সিলমোহরের অপেক্ষা করেনি। প্রতিদিন রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা দরিদ্র বাবা-মা ও তাঁদের ক্যানসার-আক্রান্ত সন্তানদের অসহায়তা দেখে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই এই ইউনিট গড়ার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কারণ, পৃথক পেডিয়াট্রিক অঙ্কোলজি বিভাগ রাজ্যের আর কোনও সরকারি হাসপাতালে নেই।
চার বছর পরে, গত ডিসেম্বরে ওই ইউনিটের দায়িত্বে থাকা একমাত্র চিকিৎসক ডায়মন্ড হারবার মেডিক্যাল কলেজে বদলি হয়ে যাওয়ায় এনআরএসের ইউনিটটি বন্ধ করে দিতে হয়েছে। চিকিৎসা অর্ধসমাপ্ত রেখেই ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে ভর্তি থাকা শিশুদের। এতে বেশির ভাগেরই মাঝপথে থমকে গিয়েছে কেমোথেরাপি। অভিযোগ, নতুন করে কোনও ক্যানসার আক্রান্ত শিশুকে ভর্তি করা হচ্ছে না। সবাইকে রেফার করা হচ্ছে অন্য হাসপাতালে।
যেহেতু অন্য সরকারি হাসপাতালে পেডিয়াট্রিক অঙ্কোলজি বিভাগ নেই, তাই কার্যত একের পর এক হাসপাতালে ধাক্কা খেয়ে বেড়াচ্ছে অসুস্থ শিশুরা। বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করানোর সামর্থ্য তাদের অধিকাংশের বাবা-মায়ের নেই। সন্তানের অবস্থার অবনতি হবে জেনেও তাঁরা বাধ্য হয়ে তাকে রেখে দিয়েছেন বাড়িতেই। এর মধ্যে কিছু শিশুর অবস্থা সঙ্কটজনক, কয়েক জনের মৃত্যুও হয়েছে।
যেমন, পুরুলিয়ার গোপালচকের আট বছরের অভিজিৎ গোপ। রক্তের ক্যানসারে আক্রান্ত অভিজিতের চিকিৎসা চলছিল এনআরএসের ওই ইউনিটে। তার জ্যাঠামশাই জয়ন্ত গোপ ফোনে বললেন, ‘‘পাঁচ-ছ’দিন আগে ছেলেটা মারা গিয়েছে। এনআরএসের ডাক্তারবাবুদের হাতে-পায়ে ধরেছিলাম যাতে হাসপাতাল থেকে না ছাড়ে। কিন্তু ওঁরা বলে দিলেন, ওখানে আর চিকিৎসা হবে না। এক ডাক্তারবাবু বললেন, ‘যে সাইকেল চালাতে পারে তাকে যদি হঠাৎ মোটরসাইকেল চালাতে দেওয়া হয় তা হলে কি সে পারবে? তেমন আমরাও আর এই চিকিৎসা চালাতে পারব না।’ ভাইপোকে বাড়ি নিয়ে এলাম। চিকিৎসা আটকে গেল। ছেলেটা বাঁচল না।’’ মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ হয়ে বাড়ি ফেরার তালিকায় রয়েছে ঋত্বিক দাস, সন্দীপ মাজি, অরণ্য মণ্ডল, রিনা মোল্লা, কুষাণ রায়, দীপ্তিকা রানা-র মতো বহু শিশু।
হাসপাতাল সূত্রের খবর, এত দিন অঙ্কোলজি, পেডিয়াট্রিক্স ও হেমাটোলজির চিকিৎসকেরা মিলিত ভাবে এই ইউনিট চালাতেন। মূল দায়িত্বে ছিলেন পেডিয়াট্রিক মেডিসিনের চিকিৎসক মানিক মণ্ডল। তিনি শিশুদের দেহে কেমোথেরাপির জন্য চ্যানেল করায় দক্ষ ছিলেন। তাঁর বদলির পরে পেডিয়াট্রিক্স বা হেমাটোলজি— কোনও বিভাগই আর এই ইউনিট চালানোর দায়িত্ব নিতে চাইছে না।
পেডিয়াট্রিক্স মেডিসিনের বিভাগীয় প্রধান তপন সিংহ মহাপাত্রের কথায়, ‘‘ওই ইউনিট তো স্বাস্থ্য ভবনের নির্দেশে হয়নি। হাসপাতাল নিজের দায়িত্বে করেছিল। শিশুদের চ্যানেল করার ব্যাপারে মানিকবাবুর দক্ষতা ছিল। এখন তিনি নেই। আর ওই ইউনিট চালানোর পরিকাঠামো বা লোকবল আমাদের নেই।’’
একই ভাবে হেমাটোলজির বিভাগীয় প্রধান প্রান্তর চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বাচ্চাদের কেমোর চ্যানেল করা বেশ জটিল। প্রশিক্ষিত লোক ছাড়া হবে না। মানিকবাবু সেটা পারতেন। আমরাও দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে গিয়ে ওঁদের যথাসাধ্য সাহায্য করেছি। এখন আমাদের বিভাগে রোগীর চাপ মারাত্মক বেড়েছে, উপরন্তু চিকিৎসক কম। ফলে আমাদের পক্ষে ওই ইউনিট চালানো অসম্ভব।’’ প্রান্তরবাবুর কথায়, ‘‘এই জন্যই এক জনের উপর ভরসা করে একটা গোটা ইউনিট খোলা অনুচিত।’’
একই কথা বলেছেন স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র। ‘‘এনআরএস ওই ইউনিট খোলার সময়ে স্বাস্থ্য দফতরের অনুমতি নেয়নি। জানলে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো দেওয়া যেত। এখন যখন ইউনিট বন্ধ করতে হয়েছে, অসুস্থ শিশুরা সঙ্কটে, তখন ওরা আমাদের জানাচ্ছে।’’— বলেন প্রদীপবাবু। তাঁর কথায়, ‘‘বিভিন্ন হাসপাতালে এক বা দু’জন চিকিৎসক-নির্ভর এমন সব ইউনিট গড়ে উঠছে সরকারি অনুমতি ছাড়াই। আমরা সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছি, এটা করা যাবে না। আর এনআরএসে এই মুহূর্তে সঙ্কট সামলাতে বাচ্চাদের কেমোর চ্যানেল করতে পারেন এমন কাউকে পোস্টিং দেওয়া যায় কি না, দেখা হচ্ছে।’’