সুজাতা বাজপেয়ী ও অভিষেক সাউ।
‘লাভ ইউ মা। গুড বাই। মেয়েকে দেখো।’
মঙ্গলবার দুপুরে শেষ বারের মতো ফোন করে এই কথাগুলোই বলেছিলেন মেয়ে সুজাতা বাজপেয়ী ওরফে প্রিয়াঙ্কা। তার পরেই ফোন বন্ধ করে দেন। এমনটাই জানাচ্ছেন মা অপর্ণা ভারতী। এর পরে বিকেলে মেয়ের গঙ্গায় ঝাঁপ দেওয়ার খবর পান। বুধবার অপর্ণা বলেন, ‘‘এক দিকে ব্রেন ক্যানসার। তার উপরে ভালবেসে যাকে বিয়ে করেছিল, সেই স্বামীও ছে়ড়ে যায়। মেয়েটা কিন্তু ভাল থাকতেই চেয়েছিল। বলেছিলাম, তিন বছরের মেয়েটার জন্য অন্তত চেষ্টা কর। পারল না। সব শেষ করে দিল!’’
মঙ্গলবার বিকেলে মাঝ গঙ্গায় যুগলের ঝাঁপ দেওয়ার ঘটনার তদন্তে পুলিশও মনে করছে, শারীরিক অসুস্থতা ও ব্যক্তিগত জীবনে টানাপড়েনের কারণেই এই কাণ্ড ঘটিয়েছেন ওই তরুণী। পুলিশ জেনেছে, সঙ্গী অভিষেক সাউ সুজাতাকে ভালবাসতেন। সুজাতার ক্যানসার অন্তিম পর্যায় থাকায় ওঁরা বেশি দিন একসঙ্গে থাকতে পারবেন না— সম্ভবত এই অবসাদ থেকে অভিষেকও ঝাঁপ দেন। দফায় দফায় তল্লাশি চালিয়ে খোঁজ মেলেনি ওই যুগলের। এক তদন্তকারী অফিসার বলেন, ‘‘ঝাঁপ দেওয়ার কারণ অনেকটাই স্পষ্ট। তবে দেহ দু’টি উদ্ধার হওয়া পর্যন্ত কিছু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।’’
পুলিশ জেনেছে, মল্লিকবাজারের একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের ছাত্রী সুজাতা পড়াশোনায় ভাল ছিলেন। ‘গ্ল্যামার’ জগতে আসার ইচ্ছে ছিল তাঁর। গ্রুপ থিয়েটারেও যোগ দিয়েছিলেন। সেখানেই পরিচয় এক যুবকের সঙ্গে। তাঁকেই বিয়ে করেন সুজাতা। তাঁদের তিন বছরের মেয়ে রয়েছে। সুজাতার ছোটবেলায় তাঁর বাবা স্ত্রী ও মেয়েকে ছেড়ে চেলে যান। মা ও স্বামীর সঙ্গে সুজাতা ইলিয়ট রোডে ঘর ভাড়া করে থাকতেন। বছর তিনেক আগে সুজাতার মস্তিষ্কের ক্যানসার ধরা পড়ে। অপর্ণাদেবীর অভিযোগ, ‘‘ক্যানসার ধরা পড়তেই সুজাতার প্রতি উদাসীন হয়ে পড়ে ওর স্বামী। গত ২৫ নভেম্বর ও বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।’’
আরও পড়ুন: সাইকেলে চেপে রাতে ফিউজ চুরি, ধৃত এক
শোকার্ত: মেয়ের জন্য কান্না মা অপর্ণা ভারতীর। (ডান দিকে) অভিষেকের বাবা ওমপ্রকাশ সাউ। নিজস্ব চিত্র
অপর্ণাদেবীর দাবি, তাঁরা ইলিয়ট রোডে যে বাড়িতে ভাড়া থাকতেন, সেখানে নির্মাণকাজ হওয়ার কথা। তাই কয়েক দিন তাঁদের অন্যত্র থাকতে বলা হয়। গত ২৫ নভেম্বর তাঁদের ‘শিফ্ট’ করার কথা ছিল। সে দিন থেকেই বেপাত্তা তাঁর জামাই। মল্লিকবাজারের একটি বাড়িতে মা ও মেয়েকে নিয়ে উঠে আসেন সুজাতা। তাঁর স্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি শুধু বলেন, ‘‘আমি সুজাতার সঙ্গে আর থাকতে পারছিলাম না।’’
আরও পড়ুন: চলন্ত সরকারি বাসে ফের আগুন
মল্লিকবাজারে সুজাতাদের থাকার ব্যবস্থা করেন অভিষেকই। সুজাতার আত্মীয়েরা জানান, ছোটবেলায় সুজাতা ও অভিষেক মল্লিকবাজারে এক পাড়ায় থাকতেন। সেখানে তাঁদের সম্পর্ক তৈরি হয়। পরে ভেঙেও যায়। অভিষেকের এক বন্ধু বলেন, ‘‘এত দিন পরে ওরা ফের একসঙ্গে থাকতে চাইছিল। কিন্তু সুজাতার ক্যানসার বাধা হয়ে দাঁড়ায়।’’
মল্লিকবাজারে গাড়ির উইন্ডস্ক্রিনের কাচের ব্যবসা অভিষেকদের। তাঁর বাবা ওমপ্রকাশ সাউ জানান, গত ৯ ডিসেম্বর বাড়ি থেকে কোথাও চলে যান অভিষেক। সুজাতার মা ওমপ্রকাশবাবুকে জানান, তাঁর ছেলে সুজাতাকে নিয়ে কোথাও চলে গিয়েছেন। গত মঙ্গলবার সুজাতাকে নিয়েই নিজের বাড়িতে ফেরেন অভিষেক। বাবাকে জানান, সুজাতাকে তাঁর মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে চান তিনি। তবে তাঁরা কোথায় গিয়েছিলেন, তা জানাননি। ওমপ্রকাশবাবুর কথায়, ‘‘মেয়েটার পরিবারের সঙ্গে আমি কথা বলতাম। সব ঠিক করে দিতাম। আমি নিজে ব্রেন ক্যানসারের চিকিৎসা করাতাম। কিন্তু ছেলে তো সেই সুযোগই দিল না।’’
রোগের কাছে হেরে গেলেন ওঁরা!